পুঁজিবাজারে বাড়ছে বিদেশি বিনিয়োগ
দীর্ঘদিন ধরে কেনার চেয়ে বেশি পরিমাণ বিক্রির পর এবার পুঁজিবাজারে শেয়ার কিনতে সক্রিয় হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুযায়ী, এপ্রিল মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিক্রির চেয়ে শেয়ার কিনেছে বেশি। ফলে পুঁজিবাজারে তাদের নীট বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এপ্রিলে বিদেশিদের নীট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৮১ কোটি টাকা, যা মার্চ মাসে ছিল মাত্র ৩ কোটি টাকা।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ১৩১ কোটি টাকা শেয়ার কিনেছে, এর বিপরীতে বিক্রি করেছে মাত্র ৫০ কোটি টাকার শেয়ার।
২০২২ সালের এপ্রিলে বিদেশিদের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে শেয়ার কিনেছিল ৬৪ কোটি টাকা আর শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৪৪ কোটি টাকা।
গ্লোবাল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিচার্ড ডি' রোজারিও ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
রিচার্ড বলেন, "মূলত ডলারের দাম নিয়ে অস্থিরতা শুরুর পর বিদেশিদের মূলধন উত্তোলন বেড়ে যায়, যাতে পুঁজিবাজারে প্রভাব পড়েছে। এখন ডলার পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল থাকায় তারা আবার পুঁজিবাজারে আসছে।"
তিনি বলেন, "দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজার নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখন আস্থা বাড়ছে, ফলে তারা ভালো রিটার্ন পাওয়ার আশায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, এটা দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারের জন্য খুবই ভালো।"
করোনা মহামারী ও সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ বিদেশি বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে।
পাশাপাশি মার্কিন ফেডারেল সুদহার বাড়ানো হয়েছে, যার কারণে ডলার আমেরিকামুখী হয়েছে। এতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছিল।
তবে গত মার্চ থেকে ডলারের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ায় শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারী ফিরে আসতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়াও ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া ও অর্থনৈতিক সংকটে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানীর ব্যবসা খারাপ হয়েছে।
তবে কাঁচামালের দাম বিশ্ববাজারের হ্রাস পাওয়া ও ডলার সংকট কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে কোম্পানীগুলোর ব্যবসা ভালো হয়েছে।
পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানীগুলো ব্যবসায় ভালো করেছে।
দেশীয় মৌলভিত্তির কিছু কোম্পানী ছাড়া বহুজাতিক কোম্পানীগুলোতে সাধারণত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ রয়েছে বেশি।
ডিএসইর তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দুই মাস বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেনার চেয়ে বেশি শেয়ার বিক্রি করেছে। তবে মার্চ ও এপ্রিলে তারা বিক্রির চেয়ে শেয়ার কিনেছে বেশি।
যদিও জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল বেশি।
ফলে চলতি বছর পরপর দুইমাস পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নীট বিনিয়োগ 'পজিটিভ' রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নীট বিনিয়োগ ছিল 'নেগেটিভ'। অর্থাৎ তারা শেয়ারে বিনিয়োগের চেয়ে বিক্রি করে মূলধন তুলে নিয়েছে অনেক বেশি।
দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা কমে আসায় পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে বলে মনে করেন মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান।
তিনি বলেন, "বিদেশিরা সবসময় শেয়ারের প্রেডিকটিবিলিটির (অনুমানযোগ্যতা) উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করে। দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসায় ডলারের দাম নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা ছিল, যা এখন কিছুটা স্থিতিশীল।"
"বিশ্ববাজারের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানীর ব্যবসা ভালো হয়নি। তবে ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে বহুজাতিক কোম্পানীসহ অনেক কোম্পানীর ব্যবসা ভালো হয়েছে। যার কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।"
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে ডিএসইতে মোট টার্নওভার ছিল ১০,২৯৬ কোটি টাকা, যেখানে কি-ইনডেক্সটি ১২ দিনের জন্য বৃদ্ধি এবং ৬ দিনের জন্য হ্রাস পায়।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "বিভিন্ন দেশের রোডশো এবং ব্রান্ডিংয়ে বাংলাদেশ ও পুঁজিবাজারের ভালো দিকগুলো তুলে ধরায় প্রবাসী ও বিদেশিদের আস্তে আস্তে বাংলাদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।"
"আমাদের বাজারে যেহেতু পিই (প্রাইস আর্নিংস) রেশিও কম, তাই এখান থেকে আরও বেশি রিটার্ন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।"
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি সায়েদুর রহমান বলেন, "করোনার পর থেকেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজার থেকে মূলধন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। পরবর্তীতে ডলারের দাম নিয়ে সংকট তৈরী হলে, তারা সাইড লাইনে চলে যায়।"
তিনি বলেন, "এখন ডলারের মূল্য মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। পুঁজিবাজারের প্রাইস আর্নিং রেশিও পার্শ্ববর্তী যেকোনো দেশের তুলনায় কম। মৌলভিত্তির কিছু কোম্পানীর শেয়ারের দামও কম রয়েছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে লাভজনক মনে করছে।"
তিনি মনে করেন, দেশের পুঁজিবাজার যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে আগামীতে আরও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।
উল্লেখ্য, ব্র্যাক ব্যাংক, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস, রেনাটা, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইসলামী ব্যাংক, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং, বিএসআরএম, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস এবং শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে।
এপ্রিল মাসের হিসাব অনুযায়ী, ব্র্যাক ব্যাংকে বিদেশিদের বিনিয়োগ রয়েছে মোট শেয়ারের ৩৩.৪০ শতাংশ। এছাড়াও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসে ২৮.৯৫%, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসে ২৭.৭৩%, রেনাটায় ২২.৭৩% এবং অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজে ২৩.২৫% বিনিয়োগ আছে।