ব্যাংকখাতে প্রকৃত প্রভিশন ঘাটতি ৫০,০০০ কোটি টাকার বেশি
দেশের ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে এর বিপরীতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ৮টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ২০,১৫৯ কোটি টাকা।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, দেশে ব্যাংকিংখাতে এখন প্রকৃত প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৫০,০০০ কোটি টাকার বেশি। কারণ একাধিক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতি কম দেখাতে ডেফারেল অ্যাডভান্টেজ নিয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকার বেশি।
ব্যাংক ৮টি হলো ন্যাশনাল ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তিনটি, চারটি বেসরকারি ব্যাংক এবং একটি বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে।
রিস্ক বেসড ক্যাপিটাল (ব্যাসেল ৩)- এর ২০২২ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ডেফারেল অ্যাডভান্টেজ নেওয়া রাষ্ট্রায়ত্ব পাঁচটি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২৮,৯৬৫ কোটি টাকা।
এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকের প্রভিশন ডেফারড রয়েছে ৩,৭২০ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৮,৫০৩ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৫,৯১১ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৬,০৪৬ কোটি টাকা এবং বেসিক ব্যাংকের ৪,৭৮৫ কোটি টাকা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরি টিবিএসকে বলেন, "সাধারণত ব্যাংকগুলোকে তার আমানতের বিপরীতে ০.৫০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। তবে খেলাপি ঋণের মান অনুযায়ী ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার নীতিমালা রয়েছে। ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে এই প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বাড়ে।"
তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে কিছু ব্যাংককে ডেফারেল সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কারণ এটি না পেলে ব্যাংকগুলোর নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়; অন্যান্য অ্যাসেটের ওপর চাপ তৈরি হয়। এ ধরনের সমস্যাগুলো নমনীয় করতে এই সুবিধা পেয়েছে একাধিক ব্যাংক। তবে ব্যাংকগুলোর এসব ঘাটতি কমিয়ে আনতে তারজন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া রয়েছে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রকৃত প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেশি; কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া নানান সুবিধার কারণে তা কম দেখা যাচ্ছে। প্রায় ১০টির বেশি রাষ্ট্রায়ত্ব, বিশেষায়িত ও বেসরকারি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতির জন্য ডেফারেল সুবিধা নিয়ে আছে।
তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলো প্রভিশন ঘাটতি ডেফারেল না পেলে রিস্ক বেসড ক্যাপিটাল (ব্যালেস ৩)-এ তাদের ওই পরিমাণ মূলধন কমে যাবে। আর মূলধন কমে গেলে ব্যাংকগুলোকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। কারণ বিদেশি ব্যাংকগুলো ব্যাংকের ক্যাপিটালের (মূলধন) মান অনুযায়ী ব্যবসা করে। কারও ক্যাপিটাল ঘাটতি থাকলে তাদের ট্রেড ফাইন্যান্সিং রেট বেশি হয়।"
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শামস-উল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ প্রভিশন রাখা উচিত, তা রাখতে গেলে ব্যাংকের প্রফিট কমে যায়; ক্যাপিটাল ঘাটতি দেখা যায়। এছাড়া, বাজারে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়।"
যদিও ব্যাংকগুলো দেশের জন্য অনেক কাজ করে যাচ্ছে কম পয়সায়। যেমন- সরকারি তেল, গ্যাস ও অন্যান্য আমদানির ক্ষেত্রে মূলত নাম মাত্র চার্জ নেয়। এছাড়া সরকারি অনেক সোশ্যাল সেফটিনেট প্রোগ্রাম রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো খুবই কম চার্জ নিয়ে করে থাকে। এসব সেবার চার্জ বেশি হলে ব্যাংকগুলো প্রভিশন ঘাটতি থাকতো না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, চলতি ২০২৩ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাড়িয়েছে ১,৩১,৬২০ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৮.৮০ শতাংশ। এরমধ্যে গত জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।
অর্থাৎ, উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংকিংখাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়।
তিন মাস আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের হিসাবে খেলাপি ঋণ ছিল ১,২০,৬৫৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশকে মঞ্জুর করা আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের কান্ট্রি রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংককে চলতি বছরের জুনের মধ্যেই লোন ক্লাসিফিকেশনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত মানদণ্ড গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া, ২০২৬ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গড় এনপিএল অনুপাত ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য এই হার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।