খেলাপি ঋণের কঠোর নীতির প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্যাংকগুলো; আর্থিক ক্ষতি, মূলধন ক্ষয়ের আশঙ্কা
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/01/11/p1_lead.jpg)
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরও খারাপ হতে চলেছে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের (এনপিএল) পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞরা।
এর পেছনের মূল কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের নতুন নিয়ম।
এ নতুন নিয়ম ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। নিয়ম অনুযায়ী, তিন মাস মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার পর সব ধরনের ঋণকে খেলাপি ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হবে। বর্তমানে এ সময়সীমা ছয় মাস। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে এ পরিবর্তন আনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে শীর্ষ ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কঠোর খেলাপি ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের নিয়ম বাস্তবায়নের সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সমস্ত ব্যাংক থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে। ব্যাংকার এবং ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলোর ধারণা, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অনুপাত ৩০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে, যা জুনের শেষ নাগাদ বোঝা যাবে।
ব্যাংকাররা একমত যে, নতুন এ শ্রেণিবিন্যাসের নিয়ম দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে তারা এসব পরিবর্তন ব্যাংক এবং ব্যবসা উভয়ের ওপর তাৎক্ষণিক আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে বলে সতর্ক করেছেন।
যেমন, যে ঋণগ্রহীতারা সময়মতো সুদ বা মূলধন পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবেন, তাদের ঋণ থেকে ব্যাংকগুলোর আয় কমে যাবে। একইসঙ্গে সম্ভাব্য ঋণক্ষতি মোকাবিলার জন্য ব্যাংকগুলোকে আরও মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। এতে এগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা সীমিত হবে। খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকের মূলধন ভিত্তিও ক্ষয় হতে পারে, যার ফলে ঝুঁকি-ভারসাম্যপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (সিএআর) ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (সিআরআইএসএল) নির্বাহী সভাপতি মুজাফফর আহমেদ আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যদি একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশে পৌঁছায়, তবে ঋণ দেওয়ার জন্য এটির সম্পদের মাত্র ৩০ শতাংশ ব্যবহার করা যাবে। এর কারণ হলো, কিছু ব্যাংকের, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের, ২৫ শতাংশ সম্পদ অ-আয়কারী এবং অতিরিক্ত ৫ শতাংশ নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর)-এর অংশ।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক ব্যবসার ওপর এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে। তাছাড়া, ব্যবসাগুলোর ওপরও চাপ তৈরি হবে।"
ব্যাংকগুলোর প্রস্তুতি
অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাবে, ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাবে, এবং মুনাফা করার সম্ভাব্যতায়ও প্রভাব পড়বে। তাহলে, ব্যাংকগুলো কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে?
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের (ডিবিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কাশেম মো. শিরিন জানান, তার ব্যাংক ইতোমধ্যে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের কঠোর এ নিয়ম বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তিনি বলেন, "আমরা লক্ষ্য করেছি, কিছু ঋণগ্রহীতার ছয়, সাত, বা এমনকি নয় মাসের বকেয়া ছিল। আমরা সফলভাবে সে অর্থ আদায় করেছি। তবে, আসল চ্যালেঞ্জ এপ্রিল থেকে শুরু হবে, যখন বকেয়া ঋণ পরিশোধের সময়সীমা তিন মাসে নেমে আসবে।"
এ সমস্যা সমাধানে ডিবিবিএল তিন কিস্তির বেশি অনাদায়ী ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। শিরিন আরও বলেন, "যেসব ঋণের আদায়ের সম্ভাবনা কম, সেগুলো বারবার পুনঃতফসিল করার চেয়ে তাৎক্ষণিক আইনি পদক্ষেপ নেওয়া ভালো।"
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, বকেয়া ঋণ আদায়ে তাদের আরও মনোযোগী হতে হবে এবং বাড়তি প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
তিনি বলেন, "খেলাপি ঋণ আদায় সফল করতে ব্যাংকগুলোর সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগের সহযোগিতা প্রয়োজন।"
এমটিবি'র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মতে, গ্রাহক আচরণ পরিবর্তন করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভালো ঋণগ্রহীতারাও ৯০ দিন পর ঋণ পরিশোধের নীতির সুযোগ নিয়েছেন।
ঋণ পরিশোধের তথ্য নিয়ে বিতর্ক?
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক ঋণদাতারা এ তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে।
একজন শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, "এ সংস্থাগুলোর কেউই আমাদের ঋণ পরিশোধের পরিসংখ্যান বিশ্বাস করে না। দেশের স্বার্থে এটি সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি।"
বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার এবং নিয়ন্ত্রক সমন্বয় জোরদার করতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২৭ নভেম্বর একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করেছে। এ সার্কুলারে ঋণের শ্রেণিবিন্যাস এবং বিধানের নতুন নিয়ম কার্যকর করা হয়েছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি ঋণে পরিণত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এম এ মান্নান খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি নতুন শ্রেণিবিন্যাস নিয়মের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আপস না করে এগুলো বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
"ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ীদের জন্য নীরব থাকা বা সংস্কার প্রতিরোধ করা একটি ঐতিহ্য। ১৯৯৫ সালে সরকার যখন মুদ্রা ও ব্যাংকিং কমিশন গঠন করে, তখন ব্যাংকগুলো তাদের প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে ভয় পেয়েছিল। তবু প্রাথমিক ধাক্কা সত্ত্বেও, ১৯৯০-এর দশকে ব্যাংকগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল," বলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের একজন প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মান্নান।
তিনি নমনীয় নিয়ন্ত্রক নীতির সমালোচনা করে বলেন, এ নীতিগুলো নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসাকে ব্যবস্থার সুযোগ নিতে সহায়তা করেছে। "ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে কিছু ঋণ বছরের পর বছর ধরে পরিশোধ করা হয়নি, তবুও সেগুলো অশ্রেণিকৃত রয়ে গেছে, যা ব্যাংকের অবস্থাকে আরও দুর্বল করে তুলেছে," তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন।
খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের, বিশেষত ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলোর দৃঢ়ভাবে কাজ করা উচিত এবং ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যকরভাবে আইন ব্যবহার করা উচিত।"
পরিসংখ্যানে সংকটের চিত্র
আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের শর্ত অনুযায়ী নীতিগত পরিবর্তন ইতোমধ্যেই এ খাতে ধাক্কা দিয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ রেকর্ড ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বেড়ে মোট ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এটি ১৬.৮৩ লাখ কোটি টাকার মোট বকেয়া ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ।
ব্যাংকাররা খেলাপি ঋণের এ বৃদ্ধিকে নয় মাস থেকে ছয় মাসে বকেয়া সময়কাল কমানোর জন্য দায়ী করেছেন। তবে, ব্যাংকার এবং বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেন, নতুন নিয়মের অধীনে খেলাপি ঋণের হার আরও তীব্রভাবে বেড়ে পেতে পারে, বিশেষত বৃহৎ কর্পোরেট ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঋণ বাড়তে পারে।
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয়কর চিত্র তুলে ধরেছে। এতে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সমস্যাগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ।
নথিতে ব্যাংকিং খাতকে "দুর্নীতিগ্রস্ত" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর হাই-প্রোফাইল ঋণগ্রহীতা এবং রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত সত্তাগুলোকে এসবের জন্য দায়ী করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ঋণগ্রহীতা তহবিল অপব্যবহার করেছেন বা বিদেশে পাচার করেছেন, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বিপদে ফেলেছে।
উদার গ্রেস পিরিয়ডের অবসান?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ২০১৯ সালে চালু হওয়া নয় মাসের গ্রেস পিরিয়ডের নিয়ম বাতিল করেছে। এ গ্রেস পিরিয়ডের ফলে ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করার আগে ছয় মাসের অতিরিক্ত সময় দিত।
এ নমনীয়তার কারণে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংস্কৃতি বেশি ছিল বলে মনে করেন সমালোচকেরা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গ্রেস পিরিয়ড কমিয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। কিন্তু আসন্ন গ্রেস পিরিয়ড তিন মাসের বৈশ্বিক মানদণ্ডে রূপান্তরের কারণে খারাপ ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাবে।
একজন সিনিয়র ব্যাংকার বলেন, "নতুন নিয়মগুলো প্রয়োজনীয়, তবে এগুলো স্বল্পমেয়াদে কষ্টসাধ্য হবে। ব্যাংকগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে এবং খারাপ ঋণ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে।"
খেলাপি অনুযায়ী ব্যবস্থা
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জি ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতার জন্য বছরের পর বছর অনিয়ন্ত্রিত ঋণ প্রদান, দুর্বল সুশাসন এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে দায়ী করেন।
"সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোতে কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে – দুর্বল কর্পোরেট সুশাসন, অকার্যকর ঋণ মূল্যায়ন এবং একক ঋণগ্রহীতার সীমা অতিক্রম," তিনি বলেন।
নতুন সংস্কার কষ্টসাধ্য হবে স্বীকার করার পাশাপাশি ড. ব্যানার্জি এ সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, "এ পরিবর্তনগুলো স্বচ্ছতা বাড়ানোর পাশাপাশি বৈশ্বিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সহায়ক হবে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
তিনি আরও বলেন, ব্যবসার স্বাস্থ্য ব্যাংকের টিকে থাকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই পরিস্থিতিগত ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের মধ্যে পার্থক্য করে সমাধান করতে হবে।
ড. ব্যানার্জি আশাবাদী যে, এ সংস্কার দীর্ঘমেয়াদে আরও স্থিতিশীল ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করবে। তিনি বলেন, "যদিও এটি কষ্টসাধ্য, তবুও এর মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।"