সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৪৯% কমছে, সংকুচিত হবে মধ্যবিত্তের বিনিয়োগের সুযোগ
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমিয়ে ১৮,০০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এখাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৪৯ শতাংশ কম।
চলতি ২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫,০০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ২০,০০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এবারের লক্ষ্যমাত্রা বিগত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯,৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। ওই সময় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ কোটি টাকার সামান্য বেশি।
বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সরকার মূলত দুটি কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমত, সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে লাগাম টেনে ধরছে অর্থ মন্ত্রণালয়; দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শ অনুসরণ করছে সরকার। আইএমএফের পরামর্শ হলো, সঞ্চয় সম্পর্কিত খরচ সরকারের মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি হবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদ প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৪২,৬৭৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে ৪৫,১০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাধারণত দেশের পেনশনারসহ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা তাদের জমানো অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ। আর সঞ্চয়পত্রের সুদহার মেয়াদভেদে সর্বোচ্চ ১১.৫২ শতাংশ। ফলে এখাত থেকে সরকার ঋণ নেওয়া কমালে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া কিংবা সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো মোটেই উচিত নয়। কারণ, এই সুদ দেশের মানুষ পায় এবং এই সুদের টাকাও দেশেই থাকে।"
সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নেওয়ার আইএমএফের শর্তে রাজি হওয়ারও বিরোধীতা করেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সঞ্চয়পত্র এমন একটি ইনস্ট্রুমেন্ট, যার মাধ্যমে সরকার একই সঙ্গে ঋণ গ্রহণ করে; আর এর বিপরীতে সরকার যে সুদ পরিশোধ করে, তার মধ্যে ব্যাংক রেটের অংশটুকু সুদ হিসেবে এবং বাকি বাড়তি সুদ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বরাদ্দ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
কিন্তু দেশের মানুষ কতো টাকার সঞ্চয়পত্র কিনবে, তার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে সাত-আট বছর ধরে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হতে থাকে। সরকারের অর্থের প্রয়োজন না থাকলেও সঞ্চয়পত্র বিক্রির বিপরীতে বাড়তি সুদ গুণতে হয়। ফলে এখাতে সরকারের সুদ ব্যয়ও বাড়তে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকার সময় থেকে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগকারীদের তথ্য ভাণ্ডার করা হয়। ফলে একই ব্যক্তি নির্ধারিত সীমায় বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৯ সাল থেকে সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজেশন করা হয় এবং নগদ টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে জনগণকে নিরুৎসাহিত করতে চলতি বছরের ১৫ মে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ইস্যু করা ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র মেয়াদ পূর্তির আগামী বছরের ২৯ জুন পর্যন্ত মুনাফা প্রাপ্ত হবেন। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে খোলা কোনো সঞ্চয়পত্র পরবর্তী পুনঃবিনিয়োগের সুবিধা প্রাপ্ত হবেন না। তবে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হলে একই দিনে অনলাইনে ৫ বছর মেয়াদী হিসাব খুলতে পারবেন।