এলএনজি আমদানির ব্যয় মেটাতে ৭,১৮১ কোটি টাকা ঋণ চায় পেট্রোবাংলা
বাংলাদেশের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পেট্রোবাংলা আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এলএনজি আমদানি ব্যয় মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৭,১৮১ কোটি টাকার ঋণ চেয়েছে।
অর্থ সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠানটি মে মাসের শেষ সপ্তাহে একটি চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়কে। চিঠিতে ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ২৫,৪৮০ কোটি টাকা লোকসানের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এলএনজি আমদানি ব্যয় নির্বাহে বর্তমানে তাদের এই ঋণ প্রয়োজন। বিশ্ববাজারে স্পট এলএনজির দর বাড়ায় ২০২২ সালের মে মাস থেকে এক বছরে তাদের লোকসানের অঙ্ক বেড়েছে ৮,০০০ কোটি টাকারও বেশি।
নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমরা পেট্রোবাংলার ঋণ প্রস্তাব নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করবো। "তার আগে, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের বর্তমান পরিস্থিতি, সংস্থাটির পুঞ্জিভূত দায়, অপারেটিং কস্টসহ পেট্রোবাংলার সামগ্রিক আয়-ব্যয়ের তথ্য পর্যালোচনা করা হবে। তাই প্রস্তাব অনুযায়ী ঋণ দেওয়া হবে কি-না, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বেশ সময় লাগবে।"
পেট্রোবাংলার সূত্রগুলোর মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বাড়ায়, সংস্থাটি আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে রাখা আমানতের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছে। এই তহবিলের ১৯,০০০ কোটি টাকার মধ্যে অবশিষ্ট আছে মাত্র ১,৫০০ কোটি টাকা।
তবে ২০১৮ সাল থেকে পেট্রোবাংলাকে সরকার ২২,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। এমনকী চলতি অর্থবছরের বাজেটে এলএনজিখাতে প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, যার পুরোটাই পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
ভর্তুকির চাপ
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি বাবদ ৩৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও, গত অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকি মেটাতেই এখান থেকে ৩০,০০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখাতের ভর্তুকি পরিশোধের জন্য মাত্র ৫,০০০ কোটি টাকার যোগান থাকবে অর্থ বিভাগের কাছে।
কয়েক সপ্তাহ আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১,৮০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদ্যুৎখাতের গত জুলাই মাসের বকেয়ার একটি অংশ পরিশোধ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণে সরকারকে সুদ গুনতে হয় ৬.৭৫ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে সরকার যেখানে গত আগস্ট থেকে বিদ্যুৎখাতের বকেয়া পরিশোধ করছে না, তখন আগামী অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এলএনজি আমদানিতে অর্থায়ন করা খুবই কঠিন হবে। আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে পেট্রোবাংলার উচিত হবে, গ্যাসের বকেয়া বিল আদায়ের ওপর জোর দেওয়া।"
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ, অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আলতাফ হোসেন বলেন, 'এই মুহূর্তে ঋণ আবেদনের অগ্রগতির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।'
অন্যদিকে, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারের মুঠোফোনে কল করে তাকে পাওয়া যায়নি।
এলএনজি আমদানির উদ্যোগগুলো
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়তে থাকলে, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি চালান ক্রয় বন্ধ করে বাংলাদেশ।
এদিকে গ্যাস সংকট অসহনীয় রূপ নিলে, ব্যবসায়ীরা বেশি দাম দিয়ে হলেও নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের অনুরোধ করেন সরকারের কাছে।
সে সময়, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম কমতেও শুরু করে। তবে জানুয়ারিতে সরকার শিল্পখাতে গ্যাসের দাম প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়ায় এবং স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে।
এদিকে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরও চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, "আমরা গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিলাম। তবে শর্ত ছিল যে, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু, সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৩০ টাকা নির্ধারণের পরও আমাদের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করছে না। আর গ্যাস সরবরাহ না থাকায় কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগও হচ্ছে না।'
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে বাংলাদেশ। এরপর গত মে মাস পর্যন্ত মোট ৩৭টি কার্গো আমদানি করা হয়েছে।
গত ১ জুন, কাতারের সঙ্গে ২০২৬ সাল থেকে বার্ষিক ১.৮ মিলিয়ন টন করে এলএনজি আমদানির ১৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তিতে সই করেছে বাংলাদেশ।
গত ১৯ জুন, ২০২৬ সাল থেকে বছরে শূন্য দশমিক ২৫ থেকে ১.৫ মিলিয়ন টন পর্যন্ত এলএনজি আমদানির লক্ষ্যে ১০ বছর মেয়াদি আরেকটি চুক্তি হয়েছে ওমানের সঙ্গে।
পেট্রোবাংলার অর্থ সংকটের শুরু যেভাবে
২০২০ সালে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন কোম্পানি, সংস্থার উদ্বৃত্ত তহবিল কোষাগারে স্থানান্তর করা শুরু করলে পেট্রোবাংলার অর্থ সংকটও শুরু হয়। এসময় অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মতো ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে উদ্বৃত্ত ও অলস তহবিল সরকারের কাছে জমা দিতে হয় পেট্রোবাংলাকে।
ওই সময় বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে সংস্থাটির আমানত ছিল ১৮,৭৬৩ কোটি টাকা, এর বিপরীতে জমা দিতে হয় ৫,৭৮১ কোটি টাকা। এরপর করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে লোকসানের সম্মুখীন হতে থাকে পেট্রোবাংলা। এতে সরকারের ওপর ভর্তুকির চাপও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।