যুদ্ধ-বিশ্বব্যাপী মন্দায় সংকটে বাইসাইকেল নির্মাতারা, কমেছে রপ্তানি
প্রায় এক যুগ ধরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডের একটি কারখানায় বাইসাইকেল উৎপাদন করছে করভো বাইসাইকেল লিমিটেড। বাইসাইকেলের পাশাপাশি পণ্যটি উৎপাদনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হতো ট্রিডেন্ট সাইকেলস কোম্পানি লিমিটেড নামে আরেকটি কারখানার মাধ্যমে। বছরে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ ইউনিট বাইসাইকেল উৎপাদন করত প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ক্রয়াদেশ না থাকায় তাইওয়ানি কোম্পানি দুটি উৎপাদন বন্ধ রয়েছে (লে-অফ) গত তিন মাস ধরে।
প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) এ কে এম তানভির উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাংলাদেশের উৎপাদিত বাইসাইকেলের রপ্তানি বাজার মূলত ইউরোপে। মহামারি পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কারণে ক্রয়াদেশ নেই। কারণ ইউরোপের ক্রেতাদের কাছে এখনো বাইসাইকেলের স্টক রয়েছে।"
"চলতি বছরের এপ্রিলের শেষ দিক থেকে কারখানা দুটি বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটির (বেপজা) লে-অফ নীতিমালা অনুযায়ী, আমাদের তিন শতাধিক শ্রমিককে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ দেওয়া হচ্ছে," বলেন তিনি।
দেশের বাইসাইকেলের রপ্তানি শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম ইপিজেডের মালয়েশিয়া ভিত্তিক কোম্পানি আলিটা বিডি লিমিটেডের হাত ধরে। প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির কারখানাও গত আট মাসে দুই দফায় প্রায় সাড়ে তিন মাস লে-অফ ছিল।
প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক এএইচএম ফেরদৌস জানান, বছরে প্রায় দেড় লাখ ইউনিট বাইসাইকেল উৎপাদিত হতো কারখানায়। ক্রয়াদেশ স্থগিত থাকায় গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে প্রায় সাড়ে তিন মাস উৎপাদন বন্ধ ছিল। ফলে বাৎসারিক উৎপাদন ৪০-৫০ হাজারে নেমে আসবে।
করভো, ট্রিডেন্ট ও আলিটার মতো বাইসাইকেল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থবিরতা চলছে। করোনা মহামারির সময় যখন অন্যান্য শিল্প নিম্নমুখী ছিল, তখন আশা জাগানিয়া ছিল বাইসাইকেল খাত। কিন্তু মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি আঘাত করেছে এই খাতকে।
গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। বর্তমানেও ক্রয়াদেশ স্থগিত রয়েছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাইসাইকেল ও অযান্ত্রিক দুই চাকার যান রপ্তানি করে বাংলাদেশে আয় করেছে ১৪২ দশমিক ২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ১৬৭ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয় আরো কমতে পারে বলে আশঙ্কা রপ্তানিকারকদের।
এ খাতের উত্থান যেভাবে
ইপিবির ও খাত সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ১৯৯৫ সালে বাইসাইকেল রপ্তানির বাজারের প্রবেশ করে বাংলাদেশ।
প্রথমদিকে শুধু বিদেশি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করত 'মেইড ইন বাংলাদেশ' ট্যাগের বাইসাইকেল। এরপর রপ্তানিকারকের তালিকায় ২০০৩ সালে দেশীয় মেঘনা গ্রুপ ও ২০১৫ সালে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ যুক্ত হয়। এরপর মূলত এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে।
রপ্তানি তালিকায় একে একে যুক্ত হতে থাকে ইউরোপ, আমেরিকা, ভারতসহ ২৯টি দেশ। এরমধ্যে ৮০ শতাংশের গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে।
একসময় ইউরোপের দেশগুলোতে বেশিরভাগ বাইসাইকেল আমদানি হতো চীন থেকে। ১৯৯৩ সাল থেকে চীনা পণ্যের উপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে ইউরোপের দেশগুলো। এই হার ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এছাড়া ২০১৩ সাল থেকে উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করা হয় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ফিলিপিন থেকে আমদানি করা সাইকেলের উপর। এর সুযোগ কাজে লাগাতে শুরু করে বাংলাদেশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে বিশ্বব্যাপী বাইসাইকেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ওইসময় অনেক দেশ উৎপাদন বন্ধ রাখলেও বাংলাদেশ সচল রাখে।
এর ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮২.৮৪ মিলিয়ন ডলারের খাত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩০.১১ মিলিয়ন ডলারের উন্নীত হয়। এর পরের অর্থবছরের আয় হয় ১৬৭.৯৫ মিলিয়ন ডলার।
তবে করোনা মহামারি সময় আউটলেটগুলো অতিরিক্ত বাইসাইকেল মজুদ করে। এরপর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটও হানা দেয়। তখন বাইসাইকেল বিক্রি কমে যায়।
বাইসাইকেলের বৈশ্বিক বাজার প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
উৎপাদন কমিয়েছে দেশীয় রপ্তানিকারকরা
বাংলাদেশ বাইসাইকেল অ্যান্ড পার্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং মেঘনা গ্রুপের পরিচালক লুৎফুল বারী টিবিএসকে বলেন, "মজুদকৃত বাইসাইকেল এখনো বিক্রি করতে পারেনি বিদেশি ক্রেতারা। এজন্য ক্রয়াদেশ নেই। এর প্রভাবে আমরা ২০-২৫ শতাংশ উৎপাদন কমিয়েছি। পরিস্থিতি এখনো বুঝতে পারছি না। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণেও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।"
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন বিভাগের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "দেশীয় বাজারে ভালো বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু গত দুই মাসে কোন বিদেশি ক্রয়াদেশ নেই। আমাদের ক্রেতারা আশা করছেন, ক্রিসমাসের আগে অর্থাৎ বছরের শেষ নাগাদ মজুদ পণ্যগুলো বিক্রি হতে পারে। এরপর অচলাবস্থা কাটবে।"
কোম্পানি সূত্রমতে, মেঘনা গ্রুপ বছরে প্রায় ৯ লাখ এবং প্রাণ আরএফএল গ্রুপ ৭ লাখ ইউনিট বাইসাইকেল উৎপাদন করে। রপ্তানির পাশাপাশি দেশীয় বাজারের জন্য দুই চাকার বাহন তৈরি করে প্রতিষ্ঠান দুটি।
ইউরোপের বাজারে মন্দা
বাংলাদেশি সাইকেল রপ্তানিকারকদের এই সংকটের পেছনে আরো একটি কারণ বৈশ্বিকভাবে সাইকেলের বিক্রি কমা।
চলতি ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ফোর্বসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মহামারি চলাকালীন সময়ে সাইকেলের বিক্রি বেড়েছে। কিন্তু এরপর থেকেই কমতে থাকে।
বাইসাইকেল অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে বার্ষিক সাইকেল বিক্রি ১.৮৮ মিলিয়ন ইউনিটে নেমে এসেছে, যা ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
'রাইডিং আউট দ্য স্টর্ম' শিরোনামে বাইসাইকেল অ্যাসোসিয়েশনের ২০২২ সালের অ্যানুয়াল মার্কেট ডেটা রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২২ সালে নন-ইলেকট্রিক বাইকের পরিমাণ ২২% কমেছে৷ ২০১৯ সালে করোনার আগের সময়ের তুলনায় এটি ২৭% কম।
বিএ'র প্রতিবেদনের লেখক জন ওর্থিংটন বলেছেন, "[বাইকের] বাজার সামনে একটি অস্থিতিশীল ও চ্যালেঞ্জিং সময়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।"
বার্তা সংস্থা এএফপির একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ফ্রান্স-ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা নিউজ ইন ফ্রান্স গত মাসে জানিয়েছে, ইইউ এবং যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে ১৪.৭ মিলিয়ন নন-ই-বাইক বিক্রি হয়েছে; যা ২০২১ থেকে ৯.১% কম।
২০২২ সালে ইউরোপে বৈদ্যুতিক বাইসাইকেল বিক্রি রেকর্ড ৫.৫ মিলিয়ন ইউনিটে পৌঁছায়। এ মহাদেশে বিক্রি হওয়া চারটি বাইকের মধ্যে একটি বাইকই বৈদ্যুতিক।
মহামারির সময় বাইসাইকেল বিক্রি বাড়ার পর ২০২২ সালে ইউরোপে বিক্রি কমতে থাকে; কিন্তু বৈদ্যুতিক বাইসাইকেল বিক্রি বাড়তে থাকে।