উচ্চমূল্যের কার্বন ফাইবার বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশ তৈরির যুগে বাংলাদেশ
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে চলছে আলফা কার্বন টেকনোলজি লিমিটেডের কর্মযজ্ঞ। ২০ বছর বয়সি সুরাইয়া হাত দিয়ে সাবধানে কার্বন ফাইবারের টুকরো জোড়া লাগাচ্ছেন। কোনো যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই নির্ভুলতা এবং অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে তাকে ২৬৮টি আলাদা টুকরো নিয়ে কাজ করতে হয়।
সুরাইয়ার মতো আরও ৩৬৫ জন কর্মী, যাদের বেশিরভাগ নারী, এ কারখানায় সাইকেলের ফ্রেম, ফোর্ক এবং সিট পোস্টের জন্য কার্বন ফাইবারের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করেন।
চীন এবং তাইওয়ানের প্রায় দুই ডজন প্রযুক্তিবিদদের নির্দেশনায় তারা প্রতিটি ধাপে নির্ভুলতার সঙ্গে প্রি-কাট কার্বন শীট জোড়া লাগান।
বাংলাদেশের জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক, কারণ সাইকেলের জন্য উচ্চ-মূল্যের কার্বন ফাইবারের খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনে দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রণী দেশ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ।
একটি কার্বন ফাইবার সাইকেল ফ্রেমের দাম প্রায় ২০০ ডলার যা এক ডলার ২০ সেন্ট মূল্যের ১৬৬টি টি-শার্টের রপ্তানি মূল্যের সমতুল্য। বিপরীতে, একটি ইস্পাতের ফ্রেমের দাম পড়ে মাত্র ২০ ডলার। আর অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের দাম ৩০ থেকে ৪০ ডলার।
দেশের বৃহত্তম বাইসাইকেল প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক মেঘনা গ্রুপ এবং জার্মানি ও তাইওয়ানের অংশীদারদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটি বর্তমানে বছরে ৫০ হাজার ফ্রেম, এক লাখ ফোর্ক ও দুই লাখ ৪০ হাজার সিট পোস্ট উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে।
কার্বন ফ্রেমের চাহিদা বাড়ছে
গত বছরের গোড়ার দিকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর পর আলফা কার্বন টেকনোলজি লিমিটেড রপ্তানি চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ক্রমবর্ধমান ক্রয়াদেশ মেটাতে কারখানার সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক জাবেদ হোসেন খান বলেন, 'নতুন অর্ডার বাড়ার কারণে আমরা আগামী বছরের জুলাইয়ের মধ্যে আমাদের ফ্রেম উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করে এক লাখ ইউনিটে উন্নীত করব।'
জাবেদ জার্মানি, সুইডেন এবং যুক্তরাজ্যের মতো মূল বাজারগুলোতে পণ্যের সফল পরীক্ষার কথা বিবেচনা করে কোম্পানির ভবিষ্যৎ রপ্তানি সম্ভাবনার ওপর আস্থা রাখছেন।
যৌথ উদ্যোগে মেঘনা গ্রুপ রপ্তানির জন্য কার্বন ফাইবার বাইসাইকেল যন্ত্রাংশ তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের এ কৌশলগত পদক্ষেপ বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করবে।
২০২৩ সালে কার্বন ফাইবার সাইকেলের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার, যেখানে প্রথাগত সাইকেলের বাজারের আকার ৮০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। তবে স্থায়িত্ব, হালকা নির্মাণ, অধিকতর শক্তি এবং মরিচা প্রতিরোধের মতো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের কারণে কার্বন ফাইবার সাইকেলের বাজার বর্তমানে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে।
এছাড়া পশ্চিমা বাজারের ক্রেতারা অ্যালুমিনিয়াম বা ইস্পাতের তৈরি সাইকেলের চেয়ে পরিবেশবান্ধব কার্বন ফাইবার বাইসাইকেলের দিকে ক্রমশ বেশি ঝুঁকছেন।
রপ্তানিতে আনবে বৈচিত্র্য
মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাংলাদেশে এ প্রযুক্তি চালু করার কৌশলগত গুরুত্বের ওপর জোর দেন। '[আমাদের] লক্ষ্য হলো দেশের রপ্তানির সুযোগগুলোকে বৈচিত্র্যময় করা, বিশেষ করে ২০২৩ জুড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজারে চিরায়ত সাইকেল বিক্রির যখন পড়তির দিকে,' তিনি বলেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই–ফেব্রুয়ারিতে দেশ থেকে বাইসাইকেল রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫৩.৮৭ মিলিয়ন ডলার, যা এক বছরের আগের একই সময়ের সাড়ে ৯৭ মিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ৪৫ শতাংশ কম।
'২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পর আমরা শুধু নিম্নপর্যায়ের পণ্যের মাধ্যমে রপ্তানি বাড়াতে পারব না। আমাদেরকে অবশ্যই বৈশ্বিক বাজারের জন্য উচ্চমানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন মিজানুর।
উদাহরণ হিসেবে তিনি পোশাক উৎপাদন থেকে জাপানের বিবর্তনের কথা উল্লেখ করেন। তিনি অনুমান করছেন, বর্তমানে পোশাক রপ্তানিতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আধিপত্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত এটি আফ্রিকার দেশগুলোতে স্থানান্তরিত হতে পারে।
'এ কৌশলের অংশ হিসেবে আমরা সাইকেলের জন্য কার্বন ফাইবার যন্ত্রাংশ উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছি। আমরা বর্তমানে ৩টি মূল যন্ত্রাংশ তৈরি করছি, কিন্তু আমাদের পরবর্তী ধাপ হলো কার্বন ফাইবারের হাতল তৈরি করা। এর পরে আমাদের সম্পূর্ণ কার্বন ফাইবার থেকে তৈরি সাইকেল রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে,' মিজানুর বলেন।
'একটি কার্বন ফাইবার সাইকেলের রপ্তানি মূল্য এক হাজার ডলারের আশপাশ থেকে শুরু হয়, খুচরা মূল্য প্রায়ই প্রতি ইউনিটের জন্য দুই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। সরকারি সহায়তা পেলে আলফা কার্বন প্রতি বছর কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের কার্বন ফাইবার বাইসাইকেল পণ্য রপ্তানি করতে পারবে,' বলেন তিনি।
'তবে এ লক্ষ্য অর্জন চ্যালেঞ্জ ছাড়া হবে না। জাপান থেকে আমদানি করা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কার্বন ফাইবারের ওপর ৬০ শতাংশ আমদানি শুল্কের কারণে কোম্পানির সরকারি সহায়তা প্রয়োজন,' মিজানুর বলেন।
'পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা। আর বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বন্ড লাইসেন্স অর্জন করা আমাদের কোম্পানির জন্য অপরিহার্য,' বলেন মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান। অন্যান্য দেশের নির্মাতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়াতে আগামী তিন বছরে ১০–১৫ শতাংশ সরকারি প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
'আমরা বছরের পর বছর বা কয়েক দশক ধরে প্রণোদনা চাই না। আমরা কয়েক বছরের মধ্যে কার্বন ফাইবার যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক হিসেবে প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা অর্জন করব,' বলেন তিনি।
বন্ড সুবিধা সাহায্য করবে
বন্ড লাইসেন্স সম্পর্কে আলফা কার্বনের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মো. লুৎফুল বারী বলেন, তাদের লাইসেন্স প্রয়োজন কারণ এটি তাদের শুল্কমুক্ত কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে সক্ষম করবে। এছাড়া শুল্ক আইন ১৯৬৯ অনুযায়ী, শতভাগ রপ্তানিমুখী ব্যবসা বন্ড সুবিধা পাওয়ার যোগ্য।
গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইলের মতো শিল্পের জন্য বন্ড লাইসেন্স শিল্প উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখতে সহায়ক হয়েছে।
লুৎফুল বারী নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের গুরুত্বের ওপরও জোর দিয়ে বলেন, যথাযথ বিদ্যুতের অভাব তাদের যন্ত্রপাতি ও পণ্যের সম্ভাব্য ক্ষতি করতে পারে।
কার্বন ফাইবার বাইক কী এবং কারা কেনে?
কার্বন ফাইবার বাইক হলো এমন সাইকেল যা মূলত কার্বন ফাইবারের শীট ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এ শীট প্রিপ্রেগ উপাদান নামেও পরিচিত। সাইকেলের ফ্রেম, ফোর্ক, সিট পোস্ট বা হুইলসেটের নকশা অনুসারে নির্দিষ্ট আকার ও আকৃতিতে কাটা হয় এটি।
এ সাইকেলগুলো প্রধানত উচ্চপর্যায়ের দৌড় প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হয়। সাধারণ ধরনের কার্বন ফাইবার সাইকেলের মধ্যে রয়েছে রোড বাইক, মাউন্টেন বাইক, সিটি বাইক ইত্যাদি।
কার্বন ফাইবার বাইকের চাহিদা বিশেষ করে ক্রীড়াবিদদের মধ্যে বেশি। রোড বাইক ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাতে জনপ্রিয় — এ দু'অঞ্চলই রোড বাইকের প্রধান বাজার। এ ধরনের সাইকেল তৈরির খরচ সামনে কমবে বলে আশা করা হচ্ছে, যার ফলে চীন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রধান বাজারের স্থানান্তর ঘটতে পারে।
যেসব দেশ কার্বন ফাইবার বাইকের যন্ত্রাংশ তৈরি করে
বেশ কয়েকটি দেশ কার্বন ফাইবার বাইসাইকেলের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরিতে বিশেষজ্ঞ। এর মধ্যে তাইওয়ান একটি নেতৃস্থানীয় উৎপাদক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। দেশটি এর উন্নত উৎপাদন ক্ষমতা এবং কার্বন ফাইবার প্রযুক্তিতে দক্ষতার জন্য বিখ্যাত।
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় সাইকেল ব্র্যান্ডের জন্য অনেক কারখানা স্থাপন করে চীনও বর্তমানে এ খাতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় পৌঁছেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে ইতালির সাইকেল উৎপাদনে দীর্ঘদিনের গর্বিত ঐতিহ্য রয়েছে। কার্বন ফাইবার প্রযুক্তিতে দেশটির কারিগরি নৈপুণ্য এবং উদ্ভাবনী সক্ষমতা বেশ মর্যাদার দাবিদার। এছাড়া প্রকৌশলবিদ্যার চমৎকারিত্বের জন্য পরিচিত জার্মানিও এ ধরনের সাইকেল তৈরি করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া এবং কলোরাডোর মতো রাজ্যগুলোতে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের সাইকেলের জন্য উচ্চ-মানসম্পন্ন কার্বন ফাইবার যন্ত্রাংশের ওপর গুরুত্ব দেয়। অন্যদিকে জাপান এ খাতে এখনো ততটা খ্যাতিমান না হয়ে উঠলেও নিখুঁত প্রকৌশল এবং উচ্চ মানদণ্ডের ক্ষেত্রে প্রশংসার দাবিদার।