২০২২ সালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে মূলধন বিনিয়োগ কেন কমলো
গত বছর প্রধান দুই বিনিয়োগকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসা কমে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান সুদের হার ও বাংলাদেশে মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যাপক অস্থিতিশীলতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়ায় পুঁজি দেশের বাইরে চলে যাওয়ার চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ক্রমাগত সুদের হার বাড়ানোর মধ্যে বিদেশি পুঁজির দেশে আসার তুলনায় দেশ থেকে বেশি বেরিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে মূলধন বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর ফলে কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত দুই বছরে বাংলাদেশের জন্য ঋণের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন। কিন্তু ২০২২ সালে দেশটি থেকে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ ১১৮ শতাংশ কমে ১৮৬.৬১ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ২০২১ সালে দেশটি থেকে নিট এফডিআই এসেছিল ৪০৭.৮৮ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর দেশ থেকে মূলধন বেরিয়ে গেছে ১৫৩ মিলিয়ন ডলার, যা অন্যান্য দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং আগের বছরের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি।
নিট এফডিআই কমে যাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র গত বছরের শীর্ষ অবস্থান থেকে পিছিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে শীর্ষ বিনিয়োগকারীর জায়গা নিয়েছে যুক্তরাজ্য।
তবে গত বছরে মূলধন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনও শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিট এফডিআই গত বছরে ৩৯.৫৭ শতাংশ কমে ৩৫৪ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিয়ে নিট মূলধন বিনিয়োগকারী দেশের তালিকায় শীর্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
আর ১০৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ইকুইটি মূলধন বিনিয়োগকারী দেশ ছিল চীন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঋণের প্রবাহও আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ কমে ৬৯৯ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ কমার কারণ জানাতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিশ্ববাজারে সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নগদ অর্থপ্রবাহ কমেছে। ফলে ভবিষ্যতের রিটার্ন প্রক্ষেপণে নতুন সুদের হার বিবেচনায় নিলে নতুন বিনিয়োগ প্রকল্প এখন আর তাদের জন্য লাভজনক হবে না।
এছাড়া গত বছর মুদ্রার বিনিময় হার খুব অস্থির ছিল। এ কারণে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া এখন বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মেজবাউল হক বলেন, এই পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মূলধন বিনিয়োগ কমেছে।
চীনা বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্তঃ-কোম্পানি ঋণ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণে এটি হয়েছে। বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশি কোম্পানিগুলো সাধারণত তাদের মূল কোম্পানির কাছ থেকে চলতি মূলধন নিয়ে থাকে। কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আন্তর্জাতিক বাজারে আরও লাভজনক জায়গায় বিনিয়োগের জন্য তাদের ঋণ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে বলে জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঞ্চমার্ক সুদের হার ৫ শতাংশ থেকে ৫.২৫ শতাংশের মধ্যে উন্নীত করেছে, যা ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রে বেঞ্চমার্ক সুদের হার ছিল শূন্যের কাছাকাছি। যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বেঞ্চমার্ক সুদের হার বাড়িয়েছে।
ফেডের এই সুদহার বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর টাকার অবমূল্যায়ন করেছে ১৭ শতাংশের বেশি। এখন প্রতি ডলারের মূল্য ১০৯ টাকা।
ডলারের দরের ব্যাপক ওঠানামা ও মূলধন বিনিয়োগে পতনের ফলে রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে। গত বছর জুলাইয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার, চলতি ১২ জুলাই তা ২৩.৫৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে নিট বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে গত বছর মোট নিট ইকুইটি মূলধন বিনিয়োগ ১০ শতাংশ কমে ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ২০২১ সালে নিট ইকুইটি মূলধন বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৫ শতাংশ।
তবে ২০২২ সালে নিট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ২০ শতাংশ বেড়ে ৩.৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এ প্রবৃদ্ধি এসেছে মূলত পুনর্বিনিয়োগকৃত আয়ের ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে।
নিট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের আরেক উপাদান আন্তঃ-কোম্পানি ঋণ গত বছর ১২৯.৬ শতাংশ কমেছে। এর কারণ বিদেশি কোম্পানিগুলো অন্যান্য বাজারে বিনিয়োগের জন্য তাদের ঋণ ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সুদহার বাড়ানোর কারণে ভারত ও চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকেও গত বছর পুঁজি বাইরে চলে গেছে।
তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে বিনিয়োগের ব্যাপক কমে গেলেও যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও নেদারল্যান্ডসের মতো অন্যান্য শীর্ষ বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে নিট বিনিয়োগের সামগ্রিক বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
চীনা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য সরকার একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দ দেওয়ার পরও চীন থেকে মূলধন বিনিয়োগ কমে গেছে।
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) মহাসচিব আল মামুন মৃধা বলেন, ২০২০ সালে মহামারিকালে চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ ও দীর্ঘাদিন ফ্লাইট বন্ধ থাকায় চীনা বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে সমস্যায় পড়েছিল।
এছাড়া সরকার কয়েক বছর আগে বরাদ্দ দিলেও অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় বিনিয়োগে বাধাগ্রস্ত হয়।
মামুন বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কিছু জটিলতা চলছিল। এরপর বিসিসিআই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে বসে সমস্যা সমাধানের জন্য।
মামুন আশা প্রকাশ করেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্পন্ন হলে অনেক চীনা বিনিয়োগকারী অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে বিনিয়োগ করবে।
চীনা বিনিয়োগ যেভাবে ঋণে পরিণত হচ্ছে
চীনের বিনিয়োগ ধরন বলছে, ঋণের মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের গভীর হচ্ছে। বাংলাদেশকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম এফডিআইয়ের উৎস থেকে অষ্টম অবস্থানে নেমে এসেছে। মোট নিট এফডিআইতে চীনের হিস্যা ১৪ শতাংশ থেকে কমে ৫.৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
তবে এফডিআই কমলেও শীর্ষ ২০ ঋণদাতা দেশের মধ্যে চীন তার শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে।
গত দুই বছরে চীন থেকে ঋণের প্রবাহ বেড়েছে পাঁচগুণ, যার ফলে বেসরকারি খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চীনা ঋণের প্রবাহ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত বছরই চীন থেকে বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৩৪ শতাংশ বেড়ে ২.৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
ফলে গত বছর বেসরকারি খাতের পাওয়া মোট ৭.৮৯ বিলিয়ন ডলারের দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণে চীনের হিস্যা ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে, ২০২০ সালে যা ৭ শতাংশ ছিল।
২০২০ সালে ৪২২ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়ে পঞ্চম বৃহত্তম ঋণদাতা দেশ ছিল চীন, যুক্তরাষ্ট্র ছিল দ্বিতীয় স্থানে। তবে ২০২১ সাল থেকে চীন বাংলাদেশের ঋণের মূল উৎস হয়ে উঠেছে। এ সময় দেশটি থেকে ঋণের প্রবাহ ক্রমাগত বেড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের মার্চে চীন থেকে ঋণের প্রবাহ ২.৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
মূলত চীন থেকে আসা বেসরকারি খাতের দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদি ঋণের বিপুল প্রবাহ এ বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ব্যাপক পেমেন্টের চাপ তৈরি করেছে। এর ফলে দ্রুত কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
ম্যাচিউরিটির ভিত্তিতে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে এক বছর পর্যন্ত মেয়াদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ৬৭.৫৩ শতাংশ। আর এক বছরের বেশি মেয়াদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল বেসরকারী খাতের মোট বৈদেশিক ঋণের ৩২.৪৭ শতাংশ। এ সময় বেসরকারি মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল ২৪ বিলিয়ন ডলার।
বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আসার তুলনায় বেরিয়ে গেছে বেশি। অন্যদিকে মুডিস দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ঋণমান কমানোর পর ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১.৪০ বিলিয়ন ডলারে, যা ৮.৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণের চেয়ে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বেশি।