ডলার চাহিদা মেটাতে বুদ্ধিদীপ্ত যেসব উপায় অবলম্বন করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো
মার্কিন ডলার শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রভাব এক বছরের বেশি সময় ধরে মোকাবিলা করতে হচ্ছে স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে। বিকল্প উপায় তেমন না থাকায় ডলারের জন্য বেশিরভাগক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর ওপরই নির্ভর করে তারা। কিন্তু, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিশ্বব্যাপী ব্যবসা রয়েছে, এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তারা জরুরি-ভিত্তিতে ডলার সংগ্রহের উপায় খুঁজতে শুরু করেছে।
শিল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, দরকারি ডলার সংগ্রহে এসব কোম্পানি – তাদের মূল বা প্যারেন্ট কোম্পানির থেকে সহায়তা নেওয়া, নিজেরাই রপ্তানি কার্যক্রমে জড়িত হওয়া এবং জরুরি চাহিদা পূরণে এমনকি রপ্তানিকারকদের সাথেও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ছে।
উদাহরণস্বরূপ; দেশের বৃহত্তম বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশের কথা বলা যায়। কোম্পানিটি মার্কিন ডলারের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন বিকল্প যাচাই-বাছাই করছে।
স্থানীয় ফাস্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডস (এফএমসিজি) বাজারের আকার ৪ বিলিয়ন ডলার—এ বাজারের ৫০ শতাংশের বেশিই ইউনিলিভার বাংলাদেশের দখলে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাভেদ আখতার বলেন, 'আমরা রপ্তানির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছি। এছাড়া, যেসব রপ্তানিকারক তাদের আয় থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় করে রাখে, আমরা তাদের সঙ্গেও কথা বলছি।'
তবে তিনি জানেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ইউনিলিভার বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি সহজ হবে না।
কাঁচামালের জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশকে আমদানির উপর নির্ভর করতে হয়। আর তাদের প্রায় ৪০ শতাংশ কাঁচামাল আসে ভারত থেকে, বাকিটা আসে চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে। অর্থাৎ, আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য ইউনিলিভারের মার্কিন ডলার প্রয়োজন।
তবে সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হওয়ায় – বাংলাদেশি আমদানিকারকরা একটি নতুন বিকল্প পেয়েছেন।
জাভেদ গত শনিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা ভারতীয় রুপিতে আমদানির জন্য এলসি খুলতে কাজ করছি। আসলে আমরা এরমধ্যেই রুপিতে একটা এলসি খুলেছি, কিন্তু সেটি খুবই ছোট।'
গত ১১ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারত রুপিতে বাণিজ্য শুরু করে। এর ফলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ডলার ছাড়াও অন্য মুদ্রায় লেনদেন নিষ্পত্তি করতে পারবেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য একচেটিয়াভাবে মার্কিন ডলারে হয়। তবে গত ১২ মাসে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় মূল্য বা মান প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় – দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
মার্কিন ডলার হচ্ছে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি সমীক্ষা অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র জড়িত থাকুক বা না থাকুক, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ লেনদেন হয় ডলারে। এশিয়া থেকে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপ পর্যন্ত অনেক দেশের মুদ্রার মান পড়ে গেছে। আর কাঁচামাল, শিল্পপণ্য, গ্যাস, জ্বালানি তেল, চিনি, ভোজ্য তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ আমদানির উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। সে কারণে এই ডলার সংকটের ধাক্কা অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের ওপর বেশি জোরে লেগেছে।
বাংলাদেশের গ্রাহকদের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল সলিউশন, সারফেস টেকনোলজি, নিউট্রিশন অ্যান্ড কেয়ার এবং অ্যাগ্রিকালচারাল সলিউশন উৎপাদন করে জার্মানির বিএএসএফ। ডলার সংকটের কারণে তারাও সমস্যায় পড়েছে।
বিএএসএফ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাজ্জাদুল হাসান শাকিল বলেন, 'আমরা আমাদের প্যারেন্ট কোম্পানি থেকে ঋণ নিচ্ছি। ঋণ পরিশোধের জন্য আমরা সাধারণত ৯০ দিন সময় নিয়ে থাকি। বাংলাদেশে চলমান ডলার সংকট বিবেচনা করে, এখন আমরা তাদের ঋণ শোধের সময় একটু পিছিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।'
সাজ্জাদুল বলেন, তার কোম্পানির ৯০ শতাংশ গ্রাহক অন্য দেশের বিএএসএফ ইউনিট থেকে সরাসরি আমদানি করা সত্ত্বেও তারা ডলার সংকটে পড়ছেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বিএএসএফের গ্রাহক ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস নিজেরাই এলসি খুলে জার্মানি বা অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানি করে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডলার পরিস্থিতির অবনতি না হলেও, উন্নতি হয়নি। তবু বড় বিদেশি ব্যাংক ও স্বনামধন্য স্থানীয় ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শুধু ইউনিলিভার বা বিএএসএফই ডলার সংকটে সমস্যায় পড়েছে, তা নয়।
গত ১৬ জুলাই, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর- রবি তাদের মূল কোম্পানি মালয়েশিয়ার বহুজাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থা- আজিয়াটা গ্রুপ থেকে ৫৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। রবি জানিয়েছে, দেশে চলমান ডলার সংকটের সম্ভাব্য প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ঋণটি নেওয়া হচ্ছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ—যারা ইউনিলিভার ও রবির মতোই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত কোম্পানি—আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে তাদের বিদেশি মূল কোম্পানি জেঅ্যান্ডএন ইনভেস্টমেন্টস (এশিয়া) লিমিটেডের সঙ্গে ৬০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করেছে। শিল্প-সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে, দেশের ৫ হাজার কোটি টাকার পেইন্টিংয়ের বাজারে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের হিস্যা ৫০ শতাংশের বেশি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করে, তখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এমনকি যুদ্ধ শুরুর চার মাস পরেও গত বছরের জুনে রিজার্ভ ছিল ৪১.৮২ বিলিয়ন ডলার। এরপরই জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার, কাঁচামাল ও খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ দ্রুত কমতে শুরু করে।
ফলে ডলারের চাহিদা আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। পাশাপাশি মুদ্রাটি ব্যাপকভাবে শক্তিশালী হয়েছে। ২০২২ সালের মার্চে এক ডলারের দাম যেখানে ৮৬ টাকা ছিল, সেখানে জুনের নাগাদ মুদ্রাটির দাম ১০০ টাকার উপরে উঠে যায়। এবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ডলারের দাম বেড়ে ১১৫ টাকা হয়ে যায়।
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে—সেটি এখন কমতে কমতে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বড় সংকট এড়াতে সরকার আইএমএফের সাথে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের চুক্তি সইয়ে বাধ্য হয়েছে।