অর্থনৈতিক মন্থরতার সময়ে উচ্চ পণ্যমূল্য বড় কোম্পানি থেকে ভ্যাট সংগ্রহ বাড়িয়েছে
বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছর জুড়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গতি না থাকলেও, দেশের বড় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আদায় লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষত আমদানি-নির্ভর পণ্যের ব্যয় বাড়ার কারণে তা ওইসব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে, যা সরকারের ভ্যাট রাজস্ব বাড়াতে সহায়তা করেছে।
এরসঙ্গে কিছু পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট হার বাড়ানোর পাশাপাশি ভ্যাট কর্মকর্তাদের নজরদারি বাড়িয়ে ফাঁকি কমানো, বকেয়া আদায়, মামলার রায় দ্রুত নিষ্পত্তি করে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করার মতো কৌশলগত পদক্ষেপ – অপেক্ষাকৃত এই ভালো ফলের কারণ বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুসারে, বড় কোম্পানিগুলোর থেকে বৃহৎ করদাতা ইউনিট বা এলটিইউ-ভ্যাট অফিসের মূসক আদায়ের পরিমাণ ছিল ৫৮ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে আদায়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের সামান্য বেশি।
অবশ্য, উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির পরও – ২০২২-২৩ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম আদায় হয়েছে ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
বছরে ৫ কোটি টাকা বা তার চেয়ে বেশি অঙ্কের ভ্যাট প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই বর্তমানে এলটিইউ-ভ্যাট অফিসের আওতাভুক্ত। এ ধরনের ৩৭ খাতের ১১০টি কোম্পানি এ অফিসের আওতায় রয়েছে।
এনবিআরের তথ্যসূত্রে দেখা গেছে, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের মূল রাজস্ব আদায়ের উৎস তামাক খাত। মোট আদায়কৃত ভ্যাটের অর্ধেকেরও বেশি এসেছে তামাক খাতের তিনটি কোম্পানির কাছ থেকে – যার নেতৃত্বে রয়েছে মূলত ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি, তাদের প্রদত্ত ভ্যাটের পরিমাণ পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এছাড়া, গত অর্থবছরজুড়ে কিছু পণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়ায় – আরও কয়েকটি খাত থেকেও ভ্যাট আদায়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে সাবান, পানীয়, সিমেন্ট, ডেইরি পণ্য, বিস্কুট, অন্যান্য খাদ্যপণ্য এবং ভোজ্যতেল থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি হারে ভ্যাট আদায় হয়েছে।
এনবিআরের সূত্রমতে, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড – ভোজ্যতেল খাতের এ দুই কোম্পানির থেকে ভ্যাট আদায় ২৪১ শতাংশের মতোন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) দিদার এম দবিরুল ইসলাম বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভোজ্যতেলের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়। তার সঙ্গে, মার্চ থেকে ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার করায় আদায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে একটি ভোক্তাপণ্য কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বিভিন্নভাবে ভ্যাট ও কর আদায়ের চাপ দিয়েছে এনবিআর, শেষপর্যন্ত যার ভার বহন করতে হয়েছে ভোক্তাদের।
অন্যদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবচর (চলতি বছরের শুরুর দিকে) শিল্পখাতে গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়, ফলে এ খাত থেকে ভ্যাট আদায় ২২ শতাংশ বেড়েছে।
দেশের সিমেন্ট খাতের ৯টি কোম্পানি এলটিইউ-ভ্যাট অফিসে ভ্যাট দেয়। গত অর্থবছরে এই কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত ভ্যাট প্রবৃদ্ধি ছিল ২৯ শতাংশ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে ক্রাউন সিমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা - মাসুদ খান বলেন, "সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারসহ আরো কিছু আনুষাঙ্গিক কাঁচামালের জন্য আমদানি-নির্ভর বাংলাদেশ। আমদানি করা কিছু কাঁচামাল ব্যয়বহুল, এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সেসবের দাম আরও বেড়ে যায়। এতে সিমেন্টের দাম বেড়ে যাওয়ায়- এ খাত থেকে সার্বিকভাবে ভ্যাট আদায় বেড়েছে।"
তিনি আরও বলেন, বড় কোম্পানিগুলো ছোটদের তুলনায় বেশি পরিমাণে ভ্যাট দিয়েছে। "অপেক্ষাকৃত ছোট কোম্পানিগুলো ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যায় পড়েছে, যা বড়দের তেমন হয়নি। এজন্য বড় কোম্পানিগুলো তুলনামূলক বাধাহীনভাবে ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পন্ন করতে পেরেছে এবং এলটিইউতে ছোট কোম্পানির চেয়ে বেশি ভ্যাটও দিয়েছে।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, এলটিইউ-ভ্যাট অফিসের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রার কারণেই প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও এনবিআর ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। ওই কর্মকর্তার মতে, মাত্রাতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায়- তা অর্জন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
পিছিয়ে ব্যাংক, বিমা খাত
কয়েকটি খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকখাতের ভ্যাট প্রবৃদ্ধি হয়েছে মোটামুটি মানের বা ৫ শতাংশ। অন্যদিকে বিমা খাতের ৬ কোম্পানি থেকে (আগের অর্থবছরের তুলনায়) ভ্যাট আদায় কমেছে প্রায় ৪.৫ শতাংশ।
এসব খাতের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা বলেছেন, অর্থনৈতিক গতি-মন্থরতার কারণে এ দুটি খাতের প্রত্যাশিত আয় দেখা যায়নি, যা ভ্যাট সংগ্রহে প্রভাব ফেলেছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা- সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "ব্যাংকখাতে ওভারঅল ব্যবসা স্লো ছিলো। ব্যবসায় এই পড়তির কারণে ব্যাংকখাত থেকে প্রত্যাশিত ভ্যাট আদায় হয়নি।"
বিমা খাতের ভ্যাট কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "মেরিন ইনস্যুরেন্স কমে গেছে। আবার পরিবহন খাতের কিছু অংশকে বিমা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যা এ খাতের ভ্যাট কমার কারণ।"
পাঁচ খাতের ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি
ভ্যাট আদায়ে গত অর্থবছরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হওয়া খাতগুলোর মধ্যে বিমা ছাড়াও রয়েছে বিদ্যুৎ বিতরণকারী, অক্সিজেন, টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি এবং বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতাধীন বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধ কমেছে। বিদ্যুতের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ খাত থেকে ভালো ভ্যাট আদায় হয়।
এছাড়া অক্সিজেন খাতে, স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অক্সিজেন কোম্পানি লিন্ডে বিডি পিছিয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের ব্যবসায়িক পারফর্ম্যান্স কমায়, এখাত থেকে ভ্যাট আদায়ও কম হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কম
অর্থনৈতিক গতি-মন্থরতা এখনো কাটেনি। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এই দুই কারণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বড় কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়ে প্রত্যাশিত গতি আসার সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন অংশীজনরা।
রবি আজিয়াটা লিমিটেড- এর চিফ কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার সাহেদুল আলম বলেন, "মূল্যস্ফীতি বাড়লে মানুষ খরচ কমায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে মোবাইল অপারেটরদের আয়ে। এছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে নতুন উদ্যোগ নিতে আর রোল-আউট এ সমস্যা হয়, যা শিল্পের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে আরও ব্যাহত করে।"