কৃষিপণ্য রপ্তানি কেন পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে
কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা এবং নীতিগত অগ্রাধিকার দেওয়া সত্ত্বেও – মানসম্মত পরীক্ষাগারের অভাব ও দুর্বল প্যাকেজিংয়ের মতো বেশকিছু কারণে বাংলাদেশ এ খাতের পূর্ণ রপ্তানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছে না। এমনটাই বলা হয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে।
২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশন বা বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণে হলে, এই খাত সরকারের নগদ প্রণোদনা ও বিভিন্ন দেশের দেওয়া রপ্তানি সুবিধাগুলো হারাবে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ফসল সংগ্রহ পরবর্তী ক্ষতি কমাতে, দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক হিমাগার ব্যবস্থা ও উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ দরকার। এছাড়া, বৈশ্বিক মান অনুসারে খাদ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মানসম্মত পণ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হলে কঠোর বিধিমালা ও দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন।
প্রতিবেদনমতে, ২০২১ সালে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ সবজি আমদানিকারক দেশের তালিকায় ছিল- যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা। এসময় তারা মোট ৩.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সবজি বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করেছে। ওই বছরে এসব দেশে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ০.০, ০.০১, ০.৫৪, ০.০২ এবং ০.০২ শতাংশ।
একইভাবে, ২০২১ সালে ফল ও শুকনো খাবার (ড্রাই ফুড) আমদানিকারক শীর্ষ পাঁচটি দেশ যথাক্রমে ৬.৮ বিলিয়ন এবং ৩.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের উভয় ধরনের পণ্য আমদানি করে। সেখানেও বাংলাদেশের রপ্তানির অংশ নামমাত্র।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, ব্রাজিল, জার্মানি, চীন শীর্ষ রপ্তানিকারকের তালিকায় রয়েছে। শীর্ষ ২২ রপ্তানিকারকের তালিকায় এশীয় দেশগুলোর মধ্যে- ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের নামও রয়েছে।
এই বাস্তবতায় আধুনিক পরীক্ষাগারে খাদ্যমান নিশ্চিত করা, বিশেষায়িত হিমাগার ও মোড়কজাত করার অবকাঠামোর ঘাটতির মতো সমস্যার সমাধান না করা গেলে – এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর নগদ প্রণোদনা ও নীতি-সহায়তা বন্ধ হলে, এই খাতের রপ্তানি বড় সংকটে পড়বে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও উইংয়ের মে মাসে প্রস্তুত করা 'গ্রাজুয়েশনের বাণিজ্য সম্পর্কিত প্রতিকূলতা চিহ্নিতকরণ ও আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খাত-ভিত্তিক বাণিজ্যিক রোড ম্যাপ প্রস্তুতকরণ' - শীর্ষক এক প্রতিবেদনে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাত নিয়ে এসব বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশের রপ্তানি নীতি ২০২১-২৪- এ কৃষি ও কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকে সর্বাধিক অগ্রাধিকারের জন্য অন্যতম খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিল্পনীতি ২০২২- এ এই খাতকে রপ্তানি বহুমুখীকরণের অন্যতম খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও, সরকার তার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ২০২১-২০২৫ - এ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির কৌশল বাস্তবায়নের জন্য বৈচিত্র্যময় কৃষি পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের উপর জোর দিয়েছে।
বর্তমানে সরকারের নানান ধরনের নীতি সহায়তা – ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা, স্থানীয় বিনিয়োগে কর ছাড়ের সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের সমর্থন থাকার পরেও, বাজার সম্প্রসারণে অগ্রগতি নেই।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিপণ্য উৎপাদনে উত্তম কৃষি চর্চার (গ্যাপ বা গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস) বড় ঘাটতি উন্নত দেশের চেইন শপগুলোয় রপ্তানি ব্যাহত করছে। বর্তমানে দেশের কৃষিপণ্য রপ্তানি যেটুকু যায়, তা প্রবাসী বাংলাদেশী ক্রেতাদের জন্যই।
প্রধান বাধাসমূহ
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফসল সংগ্রহের পর, তা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণে অবকাঠামোগত সুবিধা ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ঘাটতির মতো কৃষিপণ্য রপ্তানির প্রধান বাধাগুলো চিহ্নিত করা হয়। সেইসঙ্গে, অপর্যাপ্ত বিশেষায়িত হিমাগার ও হিম শৃঙ্খলের অভাবও অন্যতম বাধা।
মজুদ ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে, দেশের ফসল সংগ্রহ পরবর্তী ক্ষতি সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। একারণে বাংলাদেশ প্রয়োজনের বেশি পরিমাণে উৎপাদন করলেও, শেষপর্যন্ত আমদানির উপরই নির্ভর করতে হয়। অথচ এ ক্ষতি কমানোর মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। মজুদাগার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে প্রধানত আলুর জন্য। হাতেগোনা কয়েকটি কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে– যেগুলোতে কিছু পরিমাণ সবজি সংরক্ষণ করা হয়।
এছাড়া, উচ্চ বিমানভাড়া, শুল্ক প্রত্যর্পণ সুবিধার অনুপলদ্ধতা, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত খাতের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থনের ঘাটতি এবং অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ স্বীকৃতিমূলক চুক্তি ও সনদায়নের অভাবের মতো বিভিন্ন বাধাও প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অংশীজনরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ উন্নত দেশগুলোর চেইন শপে কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে হলে –পরীক্ষাগারে ফল ও সবজির মান যাচাই করাটা অপরিহার্য।
এছাড়া, কৃষিপণ্য টাটকা থাকার সময়কাল বা শেলফ লাইফ বাড়াতে হলে– অটোমেটিক ওয়াশিং ও ড্রায়িং প্ল্যান্ট, হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট এবং কুল শকের জন্য কোল্ড রুমের সুবিধাসম্পন্ন অবকাঠামো প্রয়োজন।
এশিয়ার অন্যান্য দেশ এসব সুবিধাসহ মোড়কজাত করার স্থাপনা, মজুদাগার ও মান পরীক্ষার ল্যাবরেটরি গড়ে তুললেও, ঢাকার শ্যামপুরে দেশের প্রথম প্যাকিং হাউজটিতে মাত্র আধুনিক ল্যাবরেটরি সংযোজনের কাজ চলছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্যাকিং হাউজ নিয়ে বলেন, 'ভারতে এ ধরনের প্যাকিং হাউজের সংখ্যা ৫০০'র বেশি, থাইল্যান্ডে এটা অগুনিত। 'আমরা কেবল শুরু করছি। এজন্য বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে, বিনিয়োগ করতে হবে।'
বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফভিএপিইএ) সূত্র জানায়, সবজি ও ফলমূল রপ্তানির জন্য বিমানবন্দরে মাত্র দুটি স্ক্যানার রয়েছে। এগুলো মাঝেমধ্যে নষ্ট হয়ে পড়ে, কিন্তু সারাতে অনেক সময় লেগে যায়। আবার সমস্যা রয়েছে বিমানে মালবহনের ভাড়ায়। ভারত, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভাড়া অনেক বেশি পড়ে। এটা দেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়।
অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, 'চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডের প্যাকেজিং আমাদের চেয়ে উন্নতমানের। এ কারণে বিভিন্ন দেশে তাদের পণ্যের ডিমান্ড বেশি। দেশগুলোতে অনেক প্যাকিং হাউজ রয়েছে, যেটা আমাদের দুর্বলতার জায়গা। এসব ক্ষেত্রে আমাদের মানের উন্নতি করতে হবে।'
কৃষিপণ্যের রপ্তানিকারক এবং রপ্তানি বাজার বিশ্লেষক তরুণ উদ্যোক্তা ইমরান হোসেন বলেন, 'অটোমেটিক প্যাকেজিং ও লেবেলিং শুরু হলে, সবজি এবং ফল রপ্তানির জন্য আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। কারণ অনেক বায়ারের সাথে কথা হয়, যারা চায় পণ্যে মূল্য সংযোজন, সুন্দর প্যাকেজিং। যেটা আমাদের ডেভেলপ করতে হবে।'
প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য
কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের জন্য সরকার দুই ধরনের সনদায়নের ব্যবস্থা করেছে। বিএসটিআই দিচ্ছে, হালাল পণ্যের সার্টিফিকেট এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে, আরেকটি সার্টিফিকেট।
তবে এ ধরনের পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল, আধুনিক প্রযুক্তি, সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা এবং ল্যাবরেটরির ব্যাপক অভাবের কথা বলছেন স্থানীয় শিল্প-সংশ্লিস্টরা।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল টিবিএসকে বলেন, 'বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী, মান পরীক্ষার জন্য আমাদের একটি পণ্য এখনো সিঙ্গাপুর বা ভারতের ল্যাবে পাঠাতে হচ্ছে। এটা আমাদের একটা বড় দুর্বলতা।'
তিনি আরও বলেন, 'এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে তা মোকাবিলায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি। কারণ অবকাঠামো, আধুনিক যন্ত্রপাতি, কাঁচামালের নিম্নমান এবং আধুনিক ল্যাবরেটরির সুবিধা এখানে অনেক কম। এ খাতগুলোতে বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু, সেটা করে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত রপ্তানি বাজারের উপযুক্ত হয়ে ওঠা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং।'
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিপণ্যের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১,৩৯৪ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু, প্রকৃত রপ্তানি হয়েছে ৮৪৩ মিলিয়ন ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৯.৫৩ শতাংশ কম।
আগের অর্থবছরের ১১৬২.২৫ মিলিয়ন ডলারের তুলনায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানিতে লক্ষণীয় পতন হয়েছে। এসময় সবজি রপ্তানি কমেছে ৩৯ শতাংশ, কাট ফ্লাওয়ার অ্যান্ড ফয়লেজ কমেছে ৩৭.৫০ শতাংশ, ফল ৮১ শতাংশ এবং শুকনো খাবার রপ্তানি ১৯.৮৪ শতাংশ কম হয়।
একইসঙ্গে গত অর্থবছরের তুলনায় হিমায়িত খাবার প্রায় ১১ শতাংশ এবং চিংড়ির রপ্তানি ২৬.২৭ শতাংশ কমে গেছে।