কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাজারে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ
কৃষিপণ্যের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য থাকলেও গত নয় মাসে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬৮৭ মিলিয়ন ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩২.৩৭ শতাংশ কম বলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য থেকে জানা গেছে।
কৃষিপণ্যের রপ্তানিকারকরা বলছেন, কৃষিপণ্যের রপ্তানি ঝুড়ির একটা বড় অংশ জুড়ে থাকত সুগন্ধি চাল। ওই চালের রপ্তানি গত জুলাই থেকে পুরোপুরি বন্ধ আছে। স্থানীয় চালের বাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার সুগন্ধি চালের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রপ্তানি বন্ধের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে।
বন্ধের আগে প্রতি বছর ৯.৫ হাজার থেকে ১০.৫ হাজার মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি হতো। বিশ্বের ১৩৬টি দেশেই এই চাল রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে, যে বাজার প্রতি বছরই একটু একটু করে বাড়ছিল।
কিন্তু ৯ মাস ধরে রপ্তানি বন্ধ থাকার কারণে এই বাজার হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করছেন রপ্তানিকারকরা। একইসঙ্গে নতুন করে রপ্তানি শুরু হওয়ার পরও আবার এই রপ্তানি বাজার পুনরুদ্ধার করা কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন তারা।
সুগন্ধি চাল রপ্তানির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী ভারত ও পাকিস্তান। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগীতা দিয়ে যে বাজার বাংলাদেশ তৈরি করেছিল, সেটা এখন নষ্ট হতে বসেছে বলে মন্তব্য করেছেন রপ্তানিকারকরা।
চলতি বছরের রপ্তানির জন্য ৪১টি প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমতি পেয়েছিল। এর একটি স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। তারা ৩ হাজার মেট্রিক টন চাল রপ্তানির অনুমতি পেয়েছিল।
স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের প্রধা৷ পরিচালন কর্মকর্তা পারভেজ সাইফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রপ্তানি বন্ধ থাকায় আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারছি না। অথচ প্রতি বছর এটা কৃষি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে বড় ভুমিকা রাখে।
'যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেই বাংলাদেশের সুগন্ধি চালের বাজার রয়েছে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতার বাজারে আমাদের অবস্থানটা ফিরে পেতেও কষ্ট হবে।'
শুধু সুগন্ধি চালই নয়, সামগ্রিকভাবে কৃষিপণ্যের রপ্তানিই কমেছে।
ইপিবির তথ্য বলছে, কৃষিপণ্যের রপ্তানির মধ্যে সুগন্ধি চাল, সবজি, মশলা, ড্রাই ফুড, তামাকসহ বিভিন্ন পণ্য উল্লেখযোগ্য। গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) এসব পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৯৫৮ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এই রপ্তানি চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নেমে এসেছে ৬৮৭ মিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ নয় মাসে রপ্তানি ২৮.৩১ শতাংশ কমেছে।
তবে কৃষিপণ্যের তালিকায় থাকা মশলা ও তামাকের রপ্তানি বাড়লেও ড্রাই ফুড, ফল, সবজির রপ্তানি ব্যপকভাবে কমেছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাড়তি ফ্রেইট চার্জ একটা বড় বাধা। এর কারণে ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে পণ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানির বাজারে হোঁচট খাচ্ছে বাংলাদেশ।
এছাড়া বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কার্গো স্পেস না পাওয়া, সমন্বিতভাবে কাজ না করা কৃষিপণ্যকে রপ্তানিতে পিছিয়ে দিচ্ছে বলে জানা যায়।
মনসুর জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানির স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'করোনা এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যখন সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে তখন ফ্রেইট চার্জ বাড়ানো হয়। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে এই চার্জ যৌক্তিক পর্যায়ে থাকলেও বাংলাদেশে সেটা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এ কারণে আমাদের পণ্যের খরচ বেশি পড়ছে এবং রপ্তানি কমছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ভারত যে পণ্য ১০০ টাকায় রপ্তানি করে সেটা বাংলাদেশ থেকে করতে গেলে খরচ পড়ে ১২০-১৩০ টাকা। এই যে ব্যবধান, এইর কারণে আমরা বাজার হারাচ্ছি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফ্রেইট চার্জের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের দাম ২০-৩০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। এটা একটা বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইপিবির তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সবজি রপ্তানি করে ৮১.৬৮ মিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। কিন্তু চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ নেমে এসেছে ৪৬.২৬ মিলিয়ন ডলারে। উল্লিখিত সময়ে ড্রাই ফুডের রপ্তানি কমেছে ২৯ মিলিয়ন ডলার।
তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে গুঁড়া মশলার রপ্তানি বেড়েছে ৬.৫ শতাংশ।
এর বাইরে ইপিবি অন্যান্য ক্যাটাগরিতে কৃষিপণ্যের একটা রপ্তানির হিসেব দিয়ে থাকে, যার মধ্যে ৩০ শতাংশই চালের রপ্তানি। এই ক্যাটাগরিতে রপ্তানি গত বছরের ৯ মাসে ছিল ৫৫৯.৪৯ মিলিয়ন ডলার, যেটা এ বছর নেমেছে ৩০৪ মিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এখানে রপ্তানি কমেছে ৪৫.৫৮ শতাংশ।
এছাড়া ফল রপ্তানি কমেছে ৯২ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে সাধারণত সবচেয়ে বেশি ফলমূল রপ্তানি হয় আম, কাঁঠালের সময়ে। অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রপ্তানি এমনিতেই কম থাকে। এই কমের মধ্যেও রপ্তানি কমেছে।
ইপিবির তথ্য বলছে, গত বছর ফল রপ্তানি হয়েছিল ৪.২৮ মিলিয়ন ডলার; সেটা এবার নেমেছে ০.৩৭ মিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'পান নিয়ে আমাদের একটা সমস্যা ছিল, সেটা কাটিয়ে এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে আমরা সেটা রপ্তানি করতে পারছি। কিন্তু যুক্তরাজ্যে এখনো পান রপ্তানির অনুমতি পাওয়া যায়নি। অথচ যুক্তরাজ্যেই এই পণ্যের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ রপ্তানি হয়।
'শুধু পানই নয়, বেশিরভাগ সবজির রপ্তানি গন্তব্যই যুক্তরাজ্য। এই রপ্তানি গন্তব্যগুলো ঠিকঠাক করার জন্য কিছু দরকষাকষি দ্রুত করার প্রয়োজন পড়ে, যেটা আমরা করতে পারি না।'
চাহিদা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানো যাচ্ছে না, উল্টো কমছে বলে জানান মনজুরুল। এর প্রধান কারণ হিসেবে তিনি দায়ী করেন ফ্রেইট চার্জ এবং নির্ধারিত সময়ে কার্গো স্পেইস না পাওয়াকে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ১৬২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। কিন্তু এ বছর যে অবস্থা, তাতে রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কোনো আশা দেখছেন না তারা।