কম আমদানি, রপ্তানি বাড়ায় চাপ কমেছে দেশের আন্তর্জাতিক হিসাবের ভারসাম্যে
২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে বাংলাদেশের, এর পেছনে প্রধানত অবদান রেখেছে আমদানি কমে যাওয়া এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার ঘটনা। এতে দেশের বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক হিসাবের ভারসাম্যের ওপর চাপ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ১৭.২ বিলিয়ন ডলারে, আগের অর্থবছরের ৩৩.২৫ বিলিয়ন ডলার থেকে যা প্রায় ৪৮ শতাংশ কমেছে।
ইতিবাচক এই ধারা আরও স্পষ্ট দেখা গেছে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমার ঘটনায়, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ে ১৮.৬৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩.৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আমদানির মূল্য পরিশোধ ১৩ বিলিয়ন ডলার বা ১৬ শতাংশ কমার কারণেই মূলত ঘাটতি পরিস্থিতির এই লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে।
এসব অগ্রগতিতে আশাবাদ ব্যক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, 'বাণিজ্যের ভারসাম্যে আমরা বড় উন্নতি করেছি। রপ্তানি বেড়ে যাওয়া এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন কৌশলগত পদক্ষেপ- এই অর্জনের অন্যতম কারণ।'
চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্যের উন্নতির প্রভাব পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আগের অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল সেটা এখন ছয়ভাগের একভাগে নেমেছে। রেমিট্যান্সের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিও এখানে ভূমিকা রেখেছে।'
আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬.২৮ শতাংশ, এসময়ে রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে ২.৭৫ শতাংশ। সে তুলনায়, আমদানি ব্যয় ১৫.৭৬ শতাংশ কমায়- বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পায়।
এছাড়া, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জুন মেয়াদে, আর্থিক হিসাবের ঘাটতি ২০০ মিলিয়ন ডলার কমে ২.১৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। একই অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২.৩৬ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে দেশের চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত ছিল ১৫.৪৬ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, মে মাসের তুলনায় জুনে বাণিজ্যিক, চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবের ভারসাম্যে উন্নতি হয়েছে। নতুন অর্থবছরেও ইতিবাচক এ ধারা থাকবে বলে তারা আশাপ্রকাশ করেন।
এর আগে, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক ঋণ কমে গেলে – দেশের চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দেয়, এতে চাপের মুখে পড়ে মুদ্রা রিজার্ভ।
চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। দেশের চলতি হিসাব নেতিবাচক হয়ে পড়লে, তখন আর্থিক হিসাব থেকে বৈদেশিক পেমেন্ট করতে হয়। কিন্তু, আর্থিক হিসাবও নেতিবাচক অবস্থায় চলে গেলে, তখন সরাসরি রিজার্ভ থেকে মূল্য পরিশোধ করতে হয়।
বর্তমানে, চলতি ও আর্থিক উভয় হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতির থাকার কারণেই ফরেক্স রিজার্ভ দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে বলে জানান ব্যাংকিং শিল্পের সংশ্লিষ্টরা।
আর্থিক হিসাব কেন নেতিবাচক হলো- জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতি কিছুটা অস্থিতিশীলতা ছিল। 'তাছাড়া, আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী সংস্থাগুলো আমাদের আউটলুক ডাউনগ্রেড করেছে। আমরা মূলত বৈদেশিক মুদ্রা ধার করি, তাই এর প্রতিফলন পড়েছে আমাদের আর্থিক হিসাবের ব্যালান্সে। আসলে, গতবছর বিভিন্ন কারণে দেশে ডলার আসা কমে যায়। প্রথমত, আমাদের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগে (এফডিআই) পতন হয়েছে; দ্বিতীয়ত বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়া নেতিবাচক হয়ে গেছে, যা আগে ইতিবাচক ছিল।'
বিষয়টির ব্যাখ্যা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নীতিনির্ধারক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, গত অর্থবছর আর্থিক হিসাব ইতিবাচক ছিল। 'অর্থাৎ, ওই সময়ে বিভিন্ন বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা উচ্চ পরিমাণে ঋণ নেই। চলতি বছরে এমন অনেকগুলো ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।'
'তাই আর্থিক হিসাব নেতিবাচক হওয়ার আরেক অর্থ হচ্ছে, আগামীতে আমাদের ঋণ পরিশোধের চাপ কম থাকবে'- যোগ করেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা মনে করেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর হলে এফডিআই বাড়বে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, বর্তমান অবস্থায় আর্থিক হিসাবের নেতিবাচক অবস্থান রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
গত মঙ্গলবার নাগাদ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ২৯.৭২ বিলিয়ন ডলার, এক মাস আগে যার পরিমাণ ছিল ৩০.৩৬ বিলিয়ন ডলার।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-র চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের জানিয়েছে, দেশের ব্যাংকখাতের নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) গত দুই মাস ধরে ইতিবাচক রয়েছে। আমাদের ব্যাংকখাতের জন্য এটা সুখবর। তাছাড়া, ব্যাংকের কাছে থাকা ডলারের পরিমাণের দিক থেকেও আমরা ভালো অবস্থানে আছি। গত কয়েক মাস ধরে বিওপি-র উন্নতি হচ্ছে।'
তবে চলমান ডলার সংকট অচিরেই দূর হবে না এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি জানান, 'এর কারণ, এখন আমাদের আমদানি নিম্ন, কিন্তু সেটা দীর্ঘসময় এভাবে রাখা যাবে না। আমদানি আবারো বাড়বে।'
কর্তৃপক্ষকে দেশের আর্থিক হিসাবের উন্নতি করতে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বৈদেশিক আর্থিক সম্পদ ও দায় মিলে দেশের আর্থিক হিসাব গণনা করা হয়। এর মধ্যে থাকে সরাসরি বিনিয়োগ, পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ সম্পদ। বিনিয়োগের ধারা (সম্পদ ও দায়), বিনিয়োগের দলিল (ইক্যুইটি, বন্ড, নোটস এবং ঋণ) এই হিসাবের আওতায় আসে।