ব্যাংকখাতের ক্ষত আপনি যা জানেন, তার চেয়েও গভীর
আগে যেটুকু স্বীকার করা হয়েছিল, তার চেয়েও অনেক গভীর দেশের ব্যাংকখাতের ক্ষত। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্যের অসঙ্গতির মধ্যে দিয়ে যা প্রকাশ পেয়েছে। আইএমএফের গাইডলাইন অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হিসাব দেওয়ার প্রক্রিয়া গ্রহণ করলো, তখন পুনঃতফসিলিকৃত ঋণের পরিমাণ ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে গেছে। গত দুই বছরে এগুলোর যে আনুষ্ঠানিক অংক প্রকাশ করা হয়েছিল, এই বৃদ্ধি তা-ও ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের প্রান্তিক তথ্যানুসারে, দেশের ব্যাংকসমূহের পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। অবশ্য একইবছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতার প্রতিবেদনে উঠে আসে ভিন্ন চিত্র। সেখানে এর পরিমাণ ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, বেড়েছে ১৭৭ শতাংশের বেশি।
একই ধরনের তারতম্য লক্ষ করা গেছে ২০২১ সালেও। পুরোনো হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, যেখানে পুনঃতফসিল করা ঋণ ১২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা হিসাব করা হলেও, নতুন হিসাবে উঠে আসে ২৬ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।
শ্রেণিকৃত ঋণ, মন্দঋণ (এনপিএল) ও অবলোপনসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতার সর্বশেষ এ প্রতিবেদনে। এসব মিলে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ দেশের ব্যাংকখাতের অভ্যন্তরে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। ইতঃপূর্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে অংক প্রকাশ করেছিল, এর পরিমাণ তার তিনগুণেরও বেশি। উল্লেখ্য, আগের বছরের ডিসেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দুটি প্রতিবেদনে ২০২১ সালে ব্যাংকখাতের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হিসাবে বৈসাদৃশ্য দেখা যায়; সবশেষ স্থিতিশীলতার প্রতিবেদনে ২০২১ সালে যার পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা বলা হয়েছে। আগের সংস্করণে প্রকাশিত ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকার চেয়ে যা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে।
প্রকৃত ও প্রকাশিত পরিমাণের মধ্যে এই তারতম্যের ফলে ব্যাংকখাতের নীতিগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এর ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের ব্যালান্স শিটের কৃত্রিম উন্নতি দেখানোর সুযোগ পায়।
বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির গ্রহণের আগে প্রস্তুত করা হয় ২০২১ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতার প্রতিবেদন। এতে ওই বছর মোট পুনঃশ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ দেখানো হয় ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা, যা ছিল আগের বছরের চেয়েও কম। এই কমার পেছনে ব্যাংকগুলোর আরও ভালোভাবে ঋণ ব্যবস্থাপনা করা আংশিক ভুমিকা রাখলেও, প্রতিবেদনে বলা হয়- সিংহভাগ অবদানই রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি।
প্রতিবেদনে প্রকাশ, করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালে ঋণ শ্রেণিকরণ ও পুনরুদ্ধার নীতিতে শিথিলতা অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে আংশিক পরিশোধের বিনিময়ে ঋণগুলোকে নিয়মিত রাখার সুযোগ পায় ব্যাংকসমূহ।
২০২১ সালের প্রতিবেদনের একটি চার্টে মোট বকেয়া পুনঃতফসিলিকৃত ঋণের পরিমাণ তুলে ধরা হয়– টানা চার বছর বৃদ্ধির পর– শতাংশের হিসাবে ২০২১ সালে যা ১৩.১ শতাংশ কমার কথা বলা হয়। ২০২১ সালে পুনঃতফসিলিকৃত ঋণের মোট বকেয়ার ৮০ শতাংশ শ্রেণিকরণ না করা হলেও, মোট বকেয়া পুনঃতফসিলিকৃত ঋণের মধ্যে শ্রেণিকৃত পুনঃতফসিলি ঋণের অংশ ১৯.৮ শতাংশ বাড়ে।
আইনি প্রক্রিয়ায় আটকে থাকা অনাদায়ী ও পুনঃতফসিলিকৃত ঋণের হিসাব করলে– খেলাপি ঋণের আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হিসাব, প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কম হতে পারে বলে এর আগে ২০১৯ সালে নিজেদের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পর্যালোচনার প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেয় আইএমএফ।
সাম্প্রতিক তথ্যাবলী এই অনুমানকে প্রমাণ করেছে। আইএমএফ জোর দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতার প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের সাথে পুনঃতফসিলিকৃত ঋণকেও 'ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ' হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
ঋণ পুনঃতফসিলিকরণসহ বড় ঋণ গ্রহীতাদের বিবিধ সুবিধা দেওয়ার চর্চা নিয়ে যেসব বিশ্লেষক দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনা করে আসছেন, তাদেরকে উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে সাম্প্রতিক এই তথ্য প্রকাশ।
ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'পুনঃতফসিল করা ঋণের তথ্যে ব্যাপক পার্থক্যের কারণ হতে পারে গত বছর এক বা একাধিক ব্যাংক সঠিক তথ্য দেয়নি। আবার পুনঃতফসিলিকরণের ক্লাসিফিকেশন বা ক্রাইটেরিয়াতে পরিবর্তন আনা হলেও এমন হতে পারে। তবে পুনঃতফসিলিকরণের সংজ্ঞায় কোনো পরিবর্তন আনার কথা শুনিনি। অবশ্য কোনো ব্যাংক মিস রিপোর্টিং করলে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশ করা উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'একথা সত্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রিশিডিউলিং বেড়েছে। এতে ব্যাংকের আদায় কমে যাচ্ছে। একজনের কাছে দীর্ঘদিন ধরে তহবিল আটকে থাকছে। এতে বাজারে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফ্ল্যাগশিপ এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা অবশ্য তথ্যের অমিল নিয়ে ভিন্ন কথাই বলছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বিভাগ এই আর্থিক স্থিতিশীলতার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
বিভাগের পরিচালক মো. আলা উদ্দিন বলেন, গত বছরের প্রভিশনাল তথ্য নিয়ে রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। 'অনেক ক্ষেত্রেই অডিটে প্রভিশনাল তথ্যে পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ, কোনো একটি অংক বাড়তেও পারে বা কমতেও পারে। এক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে।'
প্রতিবেদনটির প্রধান সম্পাদক আলা উদ্দিন বলেন, ২০২২ সালের সবশেষ প্রতিবেদনে আগের তথ্যের সংশোধিত অংকগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। যেকারণে কোনো কোনো সূচকে পরিবর্তন দেখা গেছে।
আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পেতে বাংলাদেশের আর্থিক কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সময়নিষ্ঠভাবে সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে। যার মাধ্যমে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের জন্য আর্থিক খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। ঋণের প্রতিটি কিস্তি ছাড়ের আগে এসব সংস্কার বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে আইএমএফ।
২০২৩ সালের আইএমএফ স্টাফ রিপোর্ট অনুসারে, ব্যাংকগুলোর ব্যালান্স শিটের দুর্বলতা কমানোর জন্য বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে- পুনঃতফসিল করা ঋণের পাশাপাশি মন্দ ঋণের অংক তুলে ধরার একটি সময়নিষ্ঠ কৌশল নিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এছাড়া, ২০২৭ সাল নাগাদ ব্যাংকখাত যাতে আইএফআরএস৯ গ্রহণ করতে পারে তারও একটি পরিকল্পনা তৈরিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে তাদের সম্পদ ও দায়ের মূল্যায়ন ও শ্রেণিকরণ করবে তারই সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড-৯ (বা আইএফআরএস৯)- এ।
গত অর্থবছরের শেষ নাগাদ এসব কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। চলতি অর্থবছরের জন্য পরিকল্পিত কার্যাবলির মধ্যে আছে, ব্যাসেল-৩ মানদণ্ড অনুসারে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের তথ্য প্রকাশ এবং মন্দঋণ কমাতে বিভিন্ন ব্যাংকের সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমঝোতা স্মারকের বাস্তবায়ন, মূলধনের পর্যাপ্ততা বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রয়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রভিশনিং কাভারেজের উন্নতি।