রোগা হওয়া ক্ষতি নয়, তবে প্রতিদিন ওজন কমাটা সমস্যার: বিরুপাক্ষ পাল
মাত্র দুই বছর আগেও বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার। রোববার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিট (আকু)-এর ১.৩ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল দেওয়ার পরে রিজার্ভ প্রায় ২১.৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
রিজার্ভ কমার এ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অভ নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ড অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পালকে উদ্বিগ্ন করেছে। এ অর্থনীতিবিদ বিনিময় হার, সুদহার সীমা, জ্ঞান-ভিত্তিক নেতৃত্বের মূল্য, আমদানি বিধিনিষেধ, বিনিয়োগ এবং আরও অনেক বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের রিজার্ভের বর্তমান অবস্থা কী এবং কেন আমরা আমাদের রিজার্ভ বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি?
আইএমএফ-এর বিপিএম ম্যানুয়াল (ব্যালেন্স অভ পেমেন্ট ম্যানুয়াল ৬) অনুযায়ী, আমাদের বর্তমান রিজার্ভ প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। কারণ সামনে আকু-র কিছু বিল পরিশোধ করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেখানোর চেষ্টা করে তাদের প্রায় চার থেকে পাঁচ মাসের কাভারেজ রয়েছে। কিন্তু তা সত্যি নয়।
অর্থমন্ত্রী গত বাজেটে বলেছিলেন, প্রায় পাঁচ মাসের কাভারেজ রয়েছে। এটিও সত্য নয়। আপনি যদি আমদানিকে খুব বেশি সীমিত করেন কেবল তাহলেই এটি সত্য হতে পারে। আর তা মোটেও স্বাস্থ্যকর কোনো লক্ষণ নয়।
আপনার প্লেটে সামান্য খাবার থাকলে আপনি হয়তো বলবেন, তা দিয়ে আপনি ১০ জনকে খাওয়াতে পারবেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনি আদতে প্রত্যেককে খুব সামান্য খাবার দিচ্ছেন। ফলে আপনি ১০ জনকে খাওয়াতে পারছেন হয়তো, [কিন্তু] সেটা স্বচ্ছল বা স্বাভাবিক উপায়ে নয়।
সুতরাং এক নম্বর উদ্বেগের বিষয় হলো, আপনি আপনার আমদানি সীমাবদ্ধ করছেন, যা শেষ পর্যন্ত আপনার উৎপাদনকে প্রভাবিত করবে। কারণ আমদানি আমাদের বিনিয়োগের অংশ — আমাদের আমদানির ৬৫ শতাংশ হলো মূলধনী যন্ত্রপাতি, ইন্টারমিটেন্ট গুডস এবং কাঁচামাল।
মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে গেছে বলে আমরা শুনেছি, যা একটি খারাপ লক্ষণ। আর ইতোমধ্যে প্রবৃদ্ধির হারে তা দেখা যেতে শুরু করেছে। এ হার আমরা ৬ শতাংশের বেশি আশা করতে পারি না।
বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ এ ব্যাপারে আরও বেশি সন্দেহ পোষণ করছে।
চলতি প্রবণতা কথা মেনে নিলে, এ মুহূর্তে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশ হওয়া উচিত ছিল। করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালীন বাংলাদেশের ভালো করার কথা ছিল, কারণ এটি একটি প্রাণবন্ত অর্থনীতি। মহামারির পরে বিশ্বের সমস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এমনকি মার্কিন অর্থনীতি ২–৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখেছে।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার গত এক দশকে ৭ শতাংশের উপরে ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে এটি এখন ৮ শতাংশ হওয়ার কথা। একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতির যে দুই অঙ্ক স্পর্শ করা উচিত, বাংলাদেশ তা কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি। তাই যদি আমি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, প্রবৃদ্ধি এখন ২ থেকে ৩ শতাংশ কম।
এর একটি কারণ আমদানি নিয়ন্ত্রণ। আপনি আপনার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেন। তারপর আপনার কভারেজ বেশি দেখান। এটা একটা চিন্তার বিষয়।
তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় আপনার কতটুকু আছে তার ভারসাম্য নয়, বরং এ ভারসাম্য হ্রাসের হার।
মাত্র দুই বছর আগেও রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। আর এখন, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের ম্যানুয়াল অনুযায়ী, আমরা ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছি। দুই বছরে এটি প্রায় ৪০ শতাংশ পতন। এই পতন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।
তাই, আমি যা বলছি তা হলো, রোগা হওয়া কোনো সমস্যা নয়। তবে আপনার ওজন যদি প্রতিদিন কমতে থাকে, সেটা একটি সমস্যা বটে।
এ প্রবণতা এক ধরনের আসন্ন সংকট নির্দেশ করছে। ব্যাপারটাকে আমি এভাবেই দেখি। আপনার কত মাসের কাভারেজ আছে তা আমি হিসাব করি না। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের পর্যায়ে পৌঁছায়নি, তবে বর্তমান ধারা বিপরীতমুখী না হলে এটিই বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
কৃত্রিমভাবে অতিমূল্যায়িত টাকার ব্যবস্থা নেওয়া রিজার্ভ সংকট মোকাবিলার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অন্যদিকে টাকার অবমূল্যায়নে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সামষ্টিক অর্থনীতিতে বেকারত্ব, প্রবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি গুরুত্বপূর্ণ চলক। এ তিনটি জিনিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আপনার হাতে দুটি পলিসি টুল আছে — সুদহার এবং বিনিময় হার। কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই অ-অর্থনৈতিক নীতিমালার চর্চা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেটি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার মানেনি। আর এখন আপনি দোষারোপ করছেন যে আপনার আমদানি চ্যানেলের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি শুরু হবে। এটি একটি ভুল অভিযোগ।
বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে ৭০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এবং ৪৫ বিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি আছে। রপ্তানির পরিমাণের ক্ষেত্রে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।
আমার কথা হলো, টাকার অবমূল্যায়ন করলে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে। কিন্তু নারকেল, পেঁয়াজ এবং কলা রাশিয়া থেকে আসে না। এগুলো দরিদ্র মানুষের ভোগ করা সাধারণ পণ্য। তাহলে এগুলোর ওপর অন্যায়ভাবে মুদ্রাস্ফীতি চাপিয়ে দিচ্ছেন কেন?
টয়োটা, মার্সিডিজ-বেঞ্জ, আমদানি করা টিভি ইত্যাদি দামি পণ্যের দাম হয়তো বাড়তে পারে। বিদেশ থেকে কাঁচামাল ব্যবহার করার কারণে কিছু উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়তে পারে। কিন্তু [আমদানি পণ্যের ওপর] মুদ্রাস্ফীতি যাতে না হয়, সেজন্য আপনি সবকিছু জুড়ে মুদ্রাস্ফীতিকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলছেন।
মুদ্রাস্ফীতিতে ভুগছেন এমন দরিদ্র মানুষ মার্সিডিজ-বেঞ্জ চালায় না। তারা চাল, তেল, ডালের মতো প্রয়োজনীয় জিনিস খায়। সয়াবিনের দাম বাড়তে পারে, কিন্তু চাল বা আলু তো বাংলাদেশে জন্মে।
এছাড়া মুদ্রাস্ফীতির ওপর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান আংশিক; তাদের উচিত দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর একটি পৃথক মুদ্রাস্ফীতি সূচক তৈরি করা। এ ক্যাটাগরির ওপর ডলার সংকটের কোন প্রভাব নেই, এবং অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে আপনাকে এটি গ্রহণ করতে হবে।
ডলারের কৃত্রিম অবমূল্যায়ন নৈতিক বিপদ এবং মানি লন্ডারিং বাড়াচ্ছে। কারণ যদি অবমূল্যায়ন করা হয়, তাহলে আমি অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে ডলার পাঠাতে প্রণোদনা পাব। হুন্ডি ব্যবহারকারীরা আমাকে কমপক্ষে ৫–৬ টাকা বেশি দেবেন, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছে যে এটি হবে বাজারভিত্তিক। একে বলে নীতি-ভণ্ডামি।
আপনি বলছেন, এটি বাজারভিত্তিক হবে। কিন্তু বাস্তবে এটি সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক নয়, বরং এটি বাফেদা এবং এবিবি'র মতো গ্রুপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাফেদা (বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন) এবং এবিবি (অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ) কারা? তারা কি বাজারের প্রতিফলক? একদমই না।
উত্তর কোরিয়ার মতোই এটি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। একই সময়ে আপনি আবার বাজারের কথা বলছেন। সুতরাং এটা হলো নীতি-ভণ্ডামি — আপনি কিছু একটা ঘোষণা করছেন কিন্তু সেটা আপনি বাস্তবে করছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংক এজন্য ভুগছে এবং এ ভোগান্তি অব্যাহত থাকবে। বাজারে যা ঘটছে ঠিক সে অনুযায়ী তাদের বিনিময় হার সামঞ্জস্য করতে হবে। তারপরও সুবিধা, গতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাহীনতার কারণে কিছু হুন্ডি রয়ে যাবে যদিও।
আর দ্বিতীয়ত, অর্থমন্ত্রী কেন প্রবাসী রেমিটারদের প্রণোদনা দিচ্ছেন? উনি কি আকাশ থেকে টাকা পাচ্ছেন? তিনি ইতোমধ্যে অনেক খরচের বোঝায় রয়েছেন আর তাকে টাকা নিতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।
দিনশেষে বাংলাদেশ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে টাকা নিয়েছে, তা শুধু ছাপিয়েই মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ভেলোসিটির সূত্র অনুযায়ী, এক টাকার অর্থ সঞ্চালন অর্থনীতিতে পাঁচ টাকা তৈরি করবে। এটি আমাদের মুদ্রাস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
তাই একদিকে আপনি আপনার বিধিনিষেধ নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন, অন্যদিকে আপনি মুদ্রাস্ফীতি বাড়াচ্ছেন। তাই এখানে দুটি বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক বোঝার ঘাটতি রয়েছে।
এমনটা ঘটছে, কারণ সঠিক লোকেরা সঠিক জায়গায় নেই — বিশেষ করে আর্থিক লাইনে।
তাদের রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ হতে পারে, কিন্তু তাদের উচিত অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করা। কিন্তু গত দুই বছর ধরে, আপনি যদি তাদের কথা শোনেন, দেখবেন অর্থনীতিবিদেরা এক ভাষায় কথা বলছেন, অথচ [অর্থ কর্তৃপক্ষের] কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা যখন ঠিকমতো কাজ করেন, সেটা কেবল হয় আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের চাপের মুখে পড়ে।
তাছাড়া মুদ্রাস্ফীতির সময় বিশ্বের সব দেশই তাদের সুদহার বাড়িয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ তাদের সুদহার পাঁচ গুণেরও বেশি বাড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রেকর্ড ন্যূনতম সময়ের মধ্যে এর সুদের হার ১১ বার বাড়িয়েছে।
কিন্তু আমরা বাড়াইনি।
আমরা অতি-ধনীদের শূন্য প্রকৃত সুদহারে ঋণ দিতে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। এটি অতি-ধনীদের সুবিধা দিচ্ছে, জাতির স্বার্থের ক্ষতি করছে, দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। রিজার্ভ হ্রাসই বলে দিচ্ছে দেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
সাম্প্রতিক একটি নিবন্ধে আপনি বলেছেন ২০২৩ সালে আট বিলিয়ন ডলার এবং ২০২২ সালে সাত বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে ঘাটতি হওয়ার পেছনে কারণ ছিল 'ভুল নীতি' পদক্ষেপ। সংকট মোকাবিলায় গৃহীত নীতিগুলো যখন কাজ করছে না তখন আপনি প্রয়োজনে 'ডাক্তার' পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে আরেকটু বিস্তারিত বলবেন?
আমি একটি খুব সাধারণ উপমা ব্যবহার করে কিছু ইঙ্গিত করেছি। একজন গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করছে কিন্তু রোগী ভালো হচ্ছে না… তার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তখন রোগীর পরিবার কী করবে? তারা রোগীকে অন্য ডাক্তার বা স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাবে।
আমরা [অর্থনীতি চালানোর জন্য] হাতুড়েদের ধরে রাখছি। আরও বিপজ্জনক ব্যাপার হলো তারা অর্থনীতিবিদদের চ্যালেঞ্জ করছেন, যেটা অনেকটা হাতুড়ে হয়ে চিকিৎসককে চ্যালেঞ্জ করার মতো।
আমরা গত এক বছর ধরে কথা বলছি, আর তারা আসলে বুঝতে পারেন যে সুদের সীমা (ক্যাপ) চালিয়ে গেলে কী হবে। এক পর্যায়ে অর্থমন্ত্রী (ক্যাপের ন্যায্যতা দিতে) বিনিয়োগ তত্ত্ব দিয়েছিলেন। ব্যাপারাটা যেন আপনার বাড়িতে আগুন লেগেছে আর আপনি স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা বলছেন। ওই মুহুর্তে আপনাকে কেবল আগুন নেভাতে হবে।
যখন মুদ্রাস্ফীতি বেশি হওয়ার কারণে বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তখন দেখুন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি একটি চাহিদার দিক। আর আপনি বরং বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলছেন? আপনি বিনা সুদেই তহবিল দিচ্ছেন।
সুতরাং আপনি তাদের ৯ শতাংশে দিচ্ছেন, যখন মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশ। অর্থাৎ তারা আসলে নিখরচায় টাকা নিচ্ছে। সেজন্য শুধু সুদের হার নয়, প্রকৃত সুদের হারও বুঝতে হবে। কেবল বিনিময় হারই নয়, প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হারও বুঝতে হবে — যেটি কি না টাকার মান কৃত্রিমভাবে বাড়ালে বাড়তে থাকে।
আর তা বাড়ার কারণে বাংলাদেশি পণ্যসমূহ বিদেশুদের কাছে তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। তাই আমাদের রপ্তানি যেমন বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে তেমন বাড়বে না এবং আমাদের আমদানিও যেমনটা হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে দ্রুত বাড়বে। তাই এটিও আমাদের ব্যালেন্স অভ পেমেন্টের ভারসাম্যকে খারাপ করছে।
পরিশেষে, যদি সবকিছু এতই ভালো ও চমৎকার হয়, তাহলে আমাদের আর্থিক অ্যাকাউন্টগুলো হঠাৎ করে নীরস হয়ে গেল কেন? হঠাৎ এক বছরের মধ্যেই? কেন? এখানে নীতিগত কিছু ভুল আছে।
আইএমএফ, রেটিং এজেন্সিগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে বাংলাদেশের অনুসরণ করা নীতিতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কোনো ইঙ্গিত নেই।
রেটিং বেশি হওয়ার পরিবর্তে আমাদের মুডি'স রেটিংয় কমে গেছে, আউটলুকও নিচে নেমে গেছে। ওদিকে অর্থনীতির নিগূঢ় দিকগুলো চিন্তা না করেই গভর্নর বলেছিলেন এমনটা নাকি ভূ-রাজনৈতিক কারণে হয়েছে।
দেখুন, আপনারা দুটি জিনিস পরিবর্তন করতে পারতেন — মাথাপিছু আয় এবং আর্থিক সক্ষমতার অভাব। মাথাপিছু ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে কারণ জিডিপি বাড়ছে। কিন্তু আপনার আর্থিক সক্ষমতার অভাব বৃদ্ধির পরিবর্তে কমে গেছে।
এটাই একমাত্র জিনিস নয় যার জন্য তারা আমাদের রেটিং কমিয়েছে। এর সঙ্গে ভুল নীতিও আছে। রিজার্ভ যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে তা বিপজ্জনক, এবং ব্যাপারটা এমন নয় যে আমরা সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার পরে এটি হ্রাস পাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা একটি বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে অতি-ধনীদের স্বার্থ রক্ষা করছি। আমরা এমন এক অবস্থার দিকে যাচ্ছি যা আমাদেরকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
করোনাভাইরাস মহামারির পরে ইউক্রেনযুদ্ধকে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতির ক্ষতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক অতীতে এ দুটি সংকট আমাদের অর্থনীতির কোন ক্ষেত্রকে এখনও প্রভাবিত করছে?
কোভিড চলে গেছে এবং এটি কতকটা ছদ্মবেশে একটা আশীর্বাদের মতো ছিল। [মহামারির কারণে] আমরা আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যোগাযোগ দক্ষতা ইত্যাদির বিকাশ করেছি। এটা আমাদের গবেষণা, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের একটি নতুন দিকে নিয়ে এসেছে।
সেজন্য সব দেশই চমৎকারভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। কোভিডের পরে যুক্তরাষ্ট্র এতটাই [অর্থনৈতিকভাবে] সহনশীল ছিল যে সুদহার বৃদ্ধি এবং আর্থিক কঠোরতা সত্ত্বেও দেশটি এখনও ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বেকারত্বের হার দেখছে।
তাহলে আপনি আর কী চান?
বেকারত্ব বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা। কোভিড এখন আর অজুহাত নয়। কোভিড একটি নতুন পর্যায় দিয়েছে আর ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া এতদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই প্রবৃদ্ধি আরও উজ্জ্বল হওয়া উচিত।
রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করেছিল, তখন এটি প্রাথমিকভাবে একটি বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এখন এসব অজুহাত প্রযোজ্য নয়। আমি একটি উদাহরণ দিই। জানুয়ারির আগে জ্বালানির দাম ছিল ৯২ ডলার, এখন তা ৮৪ ডলার। বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ কমে গেছে। তাই এ বিষয়গুলো এখন আর কোনো অজুহাত নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ রাশিয়ার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য ও চীনের সঙ্গে বেশি যুক্ত।
বাংলাদেশ রাশিয়াকে বোমা ও গোলা সরবরাহ করে না। বাংলাদেশিরা রাশিয়া থেকে অনেক বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে এমনও না। অন্যান্য বড় অর্থনীতির তুলনায় রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি সংযোগ প্রায় শূন্য, রেমিট্যান্সও খুব কম।
বাংলাদেশের অর্থনীতি পতন হতে শুরু করেছে বিশেষ করে ২০১০-এর দশকের শেষের দিকে যখন প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার এবং চলতি হিসাবের ঘাটতি কেবল বাড়তেই শুরু করে। আমরা এখন যা দেখছি তার লক্ষণ, সুদের হার এবং বিনিময় হারের ভুল নীতি — এগুলো কোভিড, রাশিয়া বা পুতিনের আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।
তাই এসব অজুহাত এখন অকেজো।
আর মার্কিন অর্থনীতির দিকে তাকান, তাদের মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা কখনো ২ শতাংশের ওপরে নয়। এটি ১০ শতাংশ বেড়ে এখন ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। তাই তাদের সাফল্য, আমি বলব ৭০ শতাংশ হ্রাস। আর আমাদের ক্ষেত্রে কোনো সাফল্যই নেই। ভুল নীতির কারণে আমাদের অর্জন শূন্য এবং কখনও কখনও ভুল নীতিনির্ধারকেরা তাদের খারাপ পারফর্ম্যান্স ঢাকতে ভুল অজুহাত তৈরি করছেন।
চলমান প্রবণতা যদি দীর্ঘকাল অব্যাহত থাকে, তাহলে আমাদের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা আরও দুর্বল হতে পারে। চলমান সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে এমন কিছু নীতিগত পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করতে পারেন?
আপনাকে ডলারের বাজারমূল্য নির্ধারণ করতে হবে। তারপর তথাকথিত প্রণোদনা বন্ধ করতে হবে। আমি রেমিটার এবং আমার অর্থমন্ত্রীর কোনো অনুগ্রহের প্রয়োজন নেই। আমার অর্থের প্রকৃত মূল্য আমার দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আমার কোনো করুণা চাই না। এটি ইতোমধ্যে অক্ষমতার বোঝায় ভারাক্রান্ত এবং তাদের অক্ষমতা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ।
আপনাকে তথাকথিত ট্রেজারি-বিলের সম্পর্কিত সুদহারের সিস্টেম বাতিল করতে হবে। ট্রেজারি বিলের সঙ্গে সুদের হারের এ কৃত্রিম সংযোগটি অদ্ভুত। যখন গভর্নরের নিজের হাতে লাগাম রাখা উচিত, তখন তিনি ট্রেজারি বিলের হারের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে লাগাম তুলে দিয়েছেন এবং এটিকে জটিল করে তুলছেন।
সুদের সর্বোচ্চ সীমা এখন ট্রেজারি বিলের হারের ওপর ২ শতাংশ করিডোরে রাখা হয়েছে। ট্রেজারি-বিলের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে নয়, সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিলের হারকে প্রভাবিত করা উচিত।
পরিশেষে, ঘাটতি নগদীকরণ বন্ধ করুন। এটি মুদ্রাস্ফীতির আগুনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। আর সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। যখন বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হয়, তখন ছোট মানি চেঞ্জার বা ব্যবসায়ীদের ধরতে আপনাকে পুলিশ বা ডিবিকে জড়ানোর দরকার নেই। বাজারভিত্তিতে রেট নির্ধারণ করা হলে কোনো পুলিশের প্রয়োজন দরকার হবে না।
সকল প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব জ্ঞানভিত্তিক হতে হবে এবং গবেষণাকে উৎসাহ দিতে হবে। কিছু স্বার্থভিত্তিক নীতিনির্ধারণ, ন্যায্যতা এবং অজুহাত খোঁজার চেয়ে বরং আপনাকে জ্ঞানের শক্তি বুঝতে হবে এবং জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব পেতে হবে।
যতক্ষণ না প্রতিষ্ঠানগুলোকে জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব এবং কিছুটা স্বাধীনতা না দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ তা হবে সংকটকে আমন্ত্রণ জানানো — এটি একধরনের স্ব-আমন্ত্রিত সংকট, যার দিকে এখন বাংলাদেশ এগোচ্ছে।