বৈশ্বিক জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলার জন্য ৫ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প
ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বিশ্ববাজারে বেড়ে যায় জীবাশ্ম জ্বালানির দাম। তারপর বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয় বাংলাদেশে। এই অবস্থায়, আগামীতে দাম বাড়ার এই চাপ মোকাবিলায় এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির কারণে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎখাতে বিনিয়োগে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে মোট ৭০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাঁচটি নতুন প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
চলতি বছরে ১,২০০ মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন ও সই হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে, ডেনমার্কের ১৩০ কোটি ডলারের অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রস্তাব। অক্টোবরে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালানোর অনুমোদন দেয় সরকার।
বিদ্যমান প্রকল্পের পাশাপাশি– অনুমোদিত ও পর্যালোচনার অধীন থাকা এসব প্রকল্পে থেকে – নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের মোট সক্ষমতা হবে ২,৭০০ মেগাওয়াট।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের ৯টি প্রকল্প থেকে ১,২৪১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার ট্যারিফ অনুমোদন করেছে সরকার। জাপান, চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব প্রকল্পের বিনিয়োগ আসছে।
গত ১ ডিসেম্বর অনুমোদিত সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ে ১০ সেন্ট (০.১০ ডলার) বা ১১ টাকা পয়সা হারে ট্যারিফ অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
বর্তমানে একটি ১০০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চারটি ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। স্থানীয় কোম্পানিগুলো হংকং, ভিয়েতনাম ও যুক্তরাজ্য-সহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে এসব প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
এক মেগাওয়াট সমান হলো– ১০ লাখ ওয়াট বা এক হাজার কিলোওয়াট, যা দিয়ে একসাথে শহরাঞ্চলের ৭৫০টি বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব।
বিদ্যুৎ বিভাগের প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি (পিপিসি) বর্তমানে প্রকল্পগুলোর বিনিয়োগকারীদের সাথে সরকার যে দাম বা ট্যারিফে বিদ্যুৎ কিনবে তা নিয়ে আলোচনা করছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রক্রিয়াকরণ কমিটি– নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো দ্রুত পর্যালোচনা করতে ধারাবাহিকভাবে সভা করছে।
মো. হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকারের নীতি হলো ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়া। "সেকারণেই আমরা সৌর বিদ্যুৎসহ রিনিউয়েবল বিদ্যুতে বিনিয়োগে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করছি, এবং আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করছি।"
তিনি বলেন, এইখাতে বিনিয়োগ উদ্যোক্তাদের জন্যও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। কারণ, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে কম সুদে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। "আমরা উদ্যোক্তাদের ন্যায্য ট্যারিফ সুবিধা দিচ্ছি এবং শুরুতেই ২০ বছর মেয়াদে বিদ্যুৎ কেনার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। আর একটি কেন্দ্র স্থাপনে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, সরকার নির্ধারিত ট্যারিফের মাধ্যমে উৎপাদনে যাওয়ার ১০ বছরের মধ্যেই বিনিয়োগের পুরো অর্থ রিটার্ন পাবেন উদ্যোক্তারা।"
সরকারের কাছ থেকে নীতি সহায়তা পাওয়া এবং ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকায় বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কনসোর্টিয়াম বা যৌথ উদ্যোগ গঠন করে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎখাতে বিনিয়োগ করছে। এপর্যন্ত যেসব বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে বা যেগুলোর ট্যারিফ সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করেছে, তার বেশিরভাগই বিদেশি বিনিয়োগ।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎসহ মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ ২০২৫ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে এই লক্ষ্য অর্জনে ততোটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের মাত্র ২ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসছে। কিন্তু, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জন করতে হলে, অন্তত ১২ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করতে হবে।
সংস্থাটির তথ্যমতে, দেশে ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ২২ টাকা। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে উৎপাদনের খরচ প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা। বড়পুকুরিয়া খনির স্থানীয় কয়লা দিয়ে প্রতি ইউনিটে ৪ টাকা এবং আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৬ টাকা। আর ফার্নেস অয়েল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই খরচ ১২ টাকা প্রতি ইউনিট। তবে এসব উৎসের কোনটি পরিবেশ-বান্ধব নয়।
পরিবেশ-বান্ধব উৎস– সৌরবিদ্যুতের বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ ইউনিটপ্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা।
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, এলএনজি ও কয়লার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে গুরুত্ব দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তারই অংশ হিসেবে বেসরকারিখাত থেকে সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্রস্তাব আসলে– তা গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করছে। সরকারের এই সংস্থা দ্রুততম সময়ে ট্যারিফ নির্ধারণ করে চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাইছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জীবাশ্ম-জ্বালানি ভিত্তিক বেসরকারিখাতের যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে সরকার বিদ্যুৎ না নিলেও– বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। কিন্তু, সৌরবিদ্যুৎ বা নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরণের কোন ক্যাপাসিটি চার্জ নেই।
"এসব কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে 'নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট' পদ্ধতিতে এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরই কেন্দ্র স্থাপনে জমির সংস্থান করতে হবে। অনুমোদন দেওয়ার পরও কোন উদ্যোক্তা প্ল্যান্ট স্থাপন না করতে পারলে সরকারের কোন লোকসান নেই'- জানান একজন কর্মকর্তা।
হঠাৎ করে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎখাতে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ভিয়েলাটেক্স এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং বাংলাদেশে সরকার অনুমোদিত সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিনিয়োগকারী ডেভিড হাসনাত টিবিএসকে বলেন, "গত এক-দেড় বছর ধরে বৈশ্বিক পর্যায়ে রিনিউয়েবল এনার্জির গুরুত্ব বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী যেসব কোম্পানি ফসিল ফুয়েল উত্তোলন, পরিশোধনসহ ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করছে। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।"
"এসব কোম্পানি তাদের ব্রান্ড ভ্যালু বাড়াতে এবং টেকসই ব্যবসা করার মাধ্যমে তাদের ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে বিশ্বব্যাপী সৌরবিদ্যুৎ-সহ রিনিউয়েবল এনার্জিতে বিনিয়োগ করছে।"
৪৩০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সৌদি কোম্পানি একুয়া পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এর সঙ্গে যৌথভাবে বাগেরহাটের রামপালে ৩০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে ভিয়েলাটেক্স।
ডেভিড হাসনাত আরও জানান, 'বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রধান চ্যালেঞ্জ পর্যাপ্ত জমি পাওয়া। এপর্যন্ত ২০ থেকে ২৫টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন পেলেও– প্রয়োজনীয় জমি সংস্থান করতে না পারায় এখনও অনেকে কাজ শুরুই করতে পারেনি। তবে রামপালে ৩০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে তাদের কাজ পুরোপুরি শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।