১৪২ বছর পর কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করল যুক্তরাজ্য
কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করার মধ্য দিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ১৪২ বছরের নির্ভরশীলতার সমাপ্তি টেনেছে যুক্তরাজ্য। র্যাটক্লিফ-অন-সোয়ার অঞ্চলে অবস্থিত দেশের শেষ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গতকাল (৩০ সেপ্টেম্বর) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১৯৬৭ সাল থেকে চালু ছিল।
এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যুক্তরাজ্যের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কয়লা সবচেয়ে দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি কারণ এটি পুড়লে সর্বাধিক পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়।
এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের জ্বালানি মন্ত্রী মাইকেল শ্যাঙ্কস বলেন, "আমরা দেশ হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে ঋণী।"
কয়লাচালিত বিদ্যুৎশক্তির জন্মস্থান যুক্তরাজ্য। আবার উন্নত অর্থনীতির দেশে হিসেবে কয়লাচালিত বিদ্যুৎশক্তি থেকে সরে আসা প্রথম দেশ হলো যুক্তরাজ্য।
সবচেয়ে বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যের পরিবেশ সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করা লর্ড ডেবেন বলেন, "এটি সত্যিই একটি চমৎকার দিন কারণ ব্রিটেন তার পুরো জ্বালানি কাঠামো কয়লার ওপর নির্ভর করেই তৈরি করেছে, এটিই শিল্প বিপ্লব।"
বিজ্ঞানী থমাস এডিসন ১৮৮২ সালে লন্ডনে বিশ্বের প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হোলবর্ন ভায়াডাক্ট পাওয়ার স্টেশন নির্মাণ করেছিলেন, যেটি লন্ডনের রাস্তাকে বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় আলোকিত করেছিল।
এরপর থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত কয়লাই যুক্তরাজ্যে বিদ্যুতের প্রধান উৎস ছিল এবং এটি ব্যবহার করেই ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শক্তি সরবরাহ করা হত।
তবে, ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে গ্যাসের প্রভাবে কয়লার ব্যবহার কমতে শুরু করে। তবুও, পরবর্তী দুই দশক ধরে কয়লা যুক্তরাজ্যের বিদ্যুৎ গ্রিডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে থেকে যায়। ২০১২ সালেও এটি ৩৯ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যবহার করা হয়েছিল।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে সবচেয়ে দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে, ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্য প্রথমবারের মতো আইনি ভিত্তিতে জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে।
২০১৫ সালে তৎকালীন জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন সচিব অ্যাম্বার রুড ঘোষণা দেন, যুক্তরাজ্য পরবর্তী দশকের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করবে।
স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এম্বার-এর গ্লোবাল ইনসাইটসের পরিচালক ডেভ জোন্স বলেন, এর ফলে কয়লা বিদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করা সহজ হয়েছিল কারণ এটি শিল্পের জন্য একটি পরিষ্কার দিকনির্দেশনা দিয়েছিল।
লর্ড ডেবেনের মতে, কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাজ্য অন্য দেশগুলোর জন্য নেতৃত্বের উদাহরণ স্থাপন করেছে এবং তাদের অনুকরণ করার জন্য একটি মানদণ্ড তৈরি করেছে।
২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য শক্তির অবদান ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে এটি বেড়ে ৫০ শতাংশের বেশি হয়েছে, যা একটি নতুন রেকর্ড।
নবায়নযোগ্য শক্তির এই সাফল্য থেকেই গত বছর যুক্তরাজ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে সোমবার র্যাটক্লিফ-অন-সোয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে, কয়লা খুবই দূষণকারী জ্বালানি হলেও এটি সবসময় পাওয়া যায়। অন্যদিকে, বাতাস ও সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের জন্য আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।
যুক্তরাজ্যের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা এনার্জি সিস্টেম অপারেটরের প্রধান কর্মকর্তা কেইট ও'নিল বলেন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থিতিশীল ও নিরাপদ রাখতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হলো ব্যাটারি প্রযুক্তি।
ফ্যারাডে ইনস্টিটিউশনের গবেষণা পরিচালক ড. সিলভিয়া ওয়ালাস বলেন, ব্যাটারি প্রযুক্তিতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ব্যাটারিগুলোকে আরও টেকসই এবং কম খরচে তৈরি করা।
এ লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যকে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেদের ব্যাটারি উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং দক্ষ কর্মী নিয়োগ করতে হবে।