সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছেই আটকে আছে ২৩,৮০০ কোটি টাকার ভ্যাট
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আটকে থাকালেও তা আদায় করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর); বরং নতুন নতুন মামলায় আটকে থাকা রাজস্বের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) বাবদ আটকে আছে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব, যার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছেই বকেয়া প্রায় ২৪,০০০ কোটি টাকা।
এর বাইরে প্রায় ১০,০০০ মামলা চলমান রয়েছে, যেখানে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ২১,৬০০ কোটি টাকা। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর জানা যাবে, এর মধ্যে প্রকৃত পক্ষে কী পরিমাণ রাজস্ব এনবিআর পাওনা হবে।
এছাড়া, ইনকাম ট্যাক্স ও কাস্টমস ডিপার্টমেন্টের বকেয়া ও মামলায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আটকে আছে। এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওইসব ডিসপ্যুটেড রাজস্বের মধ্যেও বড় অঙ্ক সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ না করার প্রবণতা রাজস্ব খাতের শৃঙ্খলা আনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একজন বিশিষ্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এসব কারণে একদিকে এনবিআর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না, অন্যদিকে যারা নিয়মিত কর দেন, তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।"
'কর না দেওয়ার সংস্কৃতি রাজস্বের শৃঙ্খলার স্বার্থ পরিপন্থী'– উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানকে পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ না করলে এক ধরনের দুষ্টচক্র তৈরি হয়।"
বুধবার (৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেও ইস্যুটি ওঠে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এনবিআর সদস্য ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, "বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য আমরা কাজ করছি এবং উচ্চ আদালতে মামলার সংখ্যা কমানোর জন্য কাজ করছি। ইতোমধ্যে অনেক মামলার রায় সরকারের পক্ষে এসেছে।"
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন পেট্রোবাংলার কাছেই বকেয়া ভ্যাট আটকে আছে ২২,০০০ কোটি টাকার ওপরে।
গত আট বছর বা তারও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটির সাথে বকেয়া ভ্যাটসহ রাজস্ব আদায়ের উপায় নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সভা হলেও কার্যকর কোনো ফল মেলেনি।
এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "সম্প্রতি ইস্যুটি নিয়ে এনবিআর সভা করেছে। কিন্তু পেট্রোবাংলা বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে বরাদ্দ পাওয়া গেলে তারা ওই টাকা পরিশোধ করবে।"
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর একটি টিম গত অক্টোবরে ঢাকা সফরকালে এনবিআরের সঙ্গে বৈঠকে পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া থাকা বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের উপায় নিয়ে জানতে চেয়েছে।
পেট্রোবাংলা ছাড়াও সরকারি আরও ২৮টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের কাছে এনবিআরের রাজস্ব বকেয়া পড়ে আছে।
এ তালিকায় রয়েছে– বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, যশোর পাসপোর্ট অফিস, বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডসহ সারাদেশের বেশ কয়েকটি পৌরসভাও রয়েছে এ তালিকায়।
এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কমপ্লায়েন্সের মধ্যে আসলে অন্যরাও উৎসাহিত হয়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে দেখা যাচ্ছে এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের পাওনা দিতে গড়িমসি করে।"
পেট্রোবাংলার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "এখন পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, অর্থমন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ না পেলে পেট্রোবাংলার পক্ষে এই অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।"
মামলায় জড়িত আরও প্রায় ২২,০০০ কোটি টাকার ভ্যাট
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১০,০০০ মামলায় জড়িত রাজস্বের পরিমাণ আরো ২১,৬০০ কোটি টাকা। বছর বছর যে পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, তার চাইতে বেশি মামলা যুক্ত হচ্ছে; যার ফলে আটকে থাকা রাজস্বের পরিমাণও বেড়ে চলেছে।
অবশ্য মামলায় থাকা সব রাজস্বই যে এনবিআর পাবে, তা নয়। অতীতে দেখা গেছে, অনেক বড় অঙ্কের মামলায় এনবিআর এক টাকাও পায়নি; অর্থাৎ রায় এনবিআরের বিপক্ষে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সময় যৌক্তিক কারণ ছাড়া রাজস্ব ডিমান্ড করা হলে শেষে গিয়ে ওই মামলা টেকে না। তবে আদালতে মামলা নিয়ে যাওয়া ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি অংশের উদ্দেশ্য থাকে মামলা করে সরকারের রাজস্ব যত বেশি সময় পর্যন্ত পারা যায়, ঝুলিয়ে রাখা।
এনবিআর সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন মনে করেন, মামলা যাতে না হয়, সেজন্য এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগেরও দায়িত্ব রয়েছে।
তিনি বলেন, "প্রতি বছর বাজেটে কিছু পরিবর্তন আসে। যে বিভাগের ওপর ট্যাক্স সংক্রান্ত পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে, এনবিআরের অফিসারদের উচিত, বাজেট শেষেই দ্রুত তাদেরকে বিষয়টি ইনফর্ম করা, বুঝিয়ে দেওয়া। কিন্তু এতে ঘাটতি রয়েছে।"
"এ কারণে মামলার সংখ্যা ও বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে", যোগ করেন তিনি।
ইএফডি চালুর পর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট সংগ্রহ বেড়েছে: এনবিআর
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন স্থাপনের সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে এনবিআর।
এনবিআর সদস্য মইনুল খান বলেন, আগে যেসব ব্যবসায় প্রতিমাসে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা ভ্যাট দিত, তারা এখন ইএফডি বসানোর পর মাসে ৫০ হাজার টাকা ভ্যাট দিচ্ছে।
তিনি বলেন, "এখন পর্যন্ত ১৮,০০০ ইএফডি মেশিন বসানো হয়েছে; চলতি অর্থ বছরে মোট ৬০,০০০টি মেশিন বসানো হবে।"
ইএফডি মেশিনগুলো এনবিআর সার্ভারের সাথে যুক্ত থাকে, যাকে ইএফডি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বলে। ফলে ইএফডি মেশিনে ইনপুট করা যেকোনো বিক্রয় তথ্য এনবিআরে চলে যায়। তাই বিক্রয়ের সময় ক্রেতার কাছ থেকে যে ভ্যাট আদায় করা হয়, তা বিক্রেতার এড়ানোর কোনো উপায় নেই।
তবে বিক্রয় তথ্যের ইনপুট না থাকলে তা এনবিআরের জানার সুযোগ থাকে না; এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ এনবিআরের জন্য। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এনবিআর একটি কোম্পানি নিয়োগ করেছে, যারা প্রক্রিয়াটি তদারকি করবে।
জাতীয় ভ্যাট দিবস উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম।
মইনুল খান বলেন, "সম্প্রতি, আমদানি প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। তবুও, গত পাঁচ মাসে ভ্যাট সংগ্রহে ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।"
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা রাজস্ব আদায়ে প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে এনবিআর সদস্য মাসুদ সাদিক বলেন, রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকলে রাজস্ব আদায় ভালো হয় তা সবাই জানে।
"তবে, এর (রাজনৈতিক অস্থিরতার) কিছু ইতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। যেমন– সিগারেট এবং কোমল পানীয়ের বিক্রি বেড়েছে," বলেন তিনি।