ধীরগতিতে চলছে ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস স্থাপনের কাজ
ভ্যাট ফাঁকি বন্ধ করে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন বসানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ঘটা করে উদ্ভোধন, দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিসহ নানান কার্যক্রম দেখা গেলেও এখনো পর্যন্ত ইএফডি বসানো হয়েছে খুব অল্প সংখ্যক।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সূত্রমতে, ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত, তিন বছরে ১৮ হাজার প্রতিষ্ঠানে বসেছে ইএফডি মেশিন। পাশাপাশি ৫০০ প্রতিষ্ঠানে সেল্ফ কন্ট্রোলার মেশিন বসাতে পেরেছে এনবিআর। যদিও ৫ বছরে সাড়ে তিন লাখ প্রতিষ্ঠানে এই ইএফডি বসানোর পরিকল্পনা ছিল সরকারি সংস্থাটির।
কিছু প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বসানো হলেও এই মেশিন ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের অনিচ্ছার অভিযোগও রয়েছে। ফলে ভ্যাট খাতে এনবিআরের অটোমেশন এখনও বহুদূরে।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ভালো প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার না দেওয়া, করোনার কারণে লকডাউন ও ডলার সংকটের কারণে ইএফডি মেশিন স্থাপনের কাজ সেভাবে এগোয়নি। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের আগ্রহ না থাকার কারণেও কার্যক্রমটি ঠিকভাবে সামনে যেতে পারেনি বলে দাবি তাদের। যদিও ইএফডি বসানোর মাধ্যমেই ভ্যাট খাতে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল সংস্থাটির।
রাজস্ব বাড়াতে অটোমেশনের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে দীর্ঘদিন আটকে থাকা দুঃখজনক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, জিডিপিতে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসার যে অবদান, তার তুলনায় খুব কমই ভ্যাট আহরণ হয়। ইএফডি বসানোর মাধ্যমে ভ্যাট ফাঁকি বন্ধ করে রাজস্ব আহরণ অনেক বাড়ানো সম্ভব ছিল।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমতুল মুনিম জানান, আজ (১০ ডিসেম্বর) শুরু হওয়া ভ্যাট সপ্তাহ ও ভ্যাট দিবসে ইএফডির ব্যবহার বাড়ানো এবং কর ফাঁকি রোধে সচেতনা বৃদ্ধিকে প্রধান লক্ষ্য হিসাবে নেওয়া হচ্ছে।
ইএফডি কী?
ক্যাশ রেজিস্টার, পয়েন্ট অফ সেল সিস্টেম এবং অন্যান্য ইনভয়েসিং সিস্টেমে কর ফাঁকি রোধের একটি সমাধান হলো এসডিসি। এটি বিক্রি এবং ট্যাক্সের তথ্য সংরক্ষণ করে। এদিকে, ইএফডিও এসডিসির মতোই একটি ডিভাইস। ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টারের জায়গায় এটি ব্যবহার করা হয়। এতে একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়।
তবে ইএফডি এসডিসির চেয়ে দামে সস্তা। তাছাড়া এই মেশিন রক্ষণাবেক্ষণের কোনো খরচ নেই। নতুন মূল্য সংযোজন কর আইনে ২৫ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ইএফডি ইনস্টলেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এনবিআর জানায়, ডিভাইসটি কেন্দ্রীয় ভ্যাট সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রতিটি সফ্টওয়্যার এবং ডিভাইসের বিপরীতে প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে একটি করে বিজনেস আইডেন্টিফকেশন নম্বর (বিআইএন) দেওয়া হয়। এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একাধিক ইএফডি ব্যবহার করা হলেও বিআইএন একই থাকে। তবে এনবিআর প্রতিটি ডিভাইসের জন্য একটি বিশেষ কোড প্রদান করে।
ফলস্বরূপ, যখন একটি ইএফডি সক্রিয় করা হয়, তখন বিভিন্ন কাস্টমস এক্সাইজ এবং ভ্যাট কমিশনারেটের এনবিআর কর্মকর্তারা সেই ব্যবসা সম্পর্কিত তথ্য জানতে অ্যাক্সেস পারবেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে খুচরা ও পাইকারি মিলিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪০ লাখ। এর অন্তত ৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে ইএফডি মেশিন বসানো যেতে পারে বলে মনে করছেন এনবিআর।
আর এটি হলে বছরে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বাড়বে বলেও মনে করছেন এনবিআর কর্মকর্তারা।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১.৩৬ লাখ কোটি টাকা। এর থেকে ১৬,০০০ কোটি টাকা কম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নির্বাচন না করায় ইনস্টলেশনে ধীরগতি
সরকার ইসিআর থেকে সরে ইএফডি মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেয় ২০১৮ সালে। ওই বছর প্রথমে ১০ হাজার ইএফডি বসাতে টেন্ডার দেয় এনবিআর। তখন চীন ভিত্তিক এসজেডজেডটি ও বাংলাদেশের সিনেসিস আইটির কনসোর্টিয়ামকে টেন্ডার দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠান দুটি দুই বছর সময় নিয়ে ২০২০ সালের প্রথম দিকে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ শুরু করলেও নানান কারণে তা আর এগোয়নি।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথম টেন্ডার দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো উপযুক্ত ছিল না। মেশিনটি সরবরাহের দায়িত্ব ছিল চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের। করোনার কারণে দীর্ঘ বিরতির পর ওই প্রতিষ্ঠিানটি কাজ শুরু করলেও ডলার সংকটসহ নানা কারণে ইনস্টলেশন এগোয়নি। যদিও সম্প্রতি দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে ইএফডি স্থাপনের গতি বাড়ানোর দাবি করছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমতুল মুনিম।
বৃহস্পতিবার ভ্যাট দিবসের সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, গত আগস্টে দেশীয় প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
"আমরা এখন প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপের ভিত্তিতে ইএফডি ও এসডিসি মেশিন স্থাপন করছি। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ হাজার ও প্রতি বছর ৬০ হাজার ইএফডি ও এসডিসি স্থাপন করা হবে। আগামী ৫ বছরের ৩ লাখ ডিভাইস স্থাপন করা হবে। যার মাধ্যমে করদাতারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাখিলপত্র পেশ ও প্রদেয় কর অনলাইনে পরিশোধ করতে পারবেন। সারাদেশে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫টি ইএফডি ও ৫০০ এসডিসি স্থাপন করা হয়েছে," বলেন তিনি।
ভ্যাট ফাঁকি দিতে ইএফডি ছাড়া বিক্রি
২০২০ সালের শুরুতে প্রথম ইএফডি বসানো প্রক্রিয়া শুরুর কারা তিন বছর পরও ঢাকার বড় বড় দোকানে ঘুরে ইএফডি মেশিনের দেখা পাওয়া কঠিন। রাজধানীর বসুন্ধরা শপিংমল, মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, মালিবাগের ফরচুন শপিংমলসহ কয়েকটি মার্কেটের কিছু দোকানে এ মেশিন পাওয়া গেলেও ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই লেনদেন হতে দেখা গেছে।
দোকানীদের দাবি, কাস্টমাররা ভ্যাট ছাড়া পণ্য কিনতে চান। তারা বলছেন, কিছু বড় দোকানে ইএফডি বসানোতে তারা অন্যান্য দোকানে, যেখানে এই মেশিন বসানো হয়নি, তাদের তুলনায় অসুবিধাজনক অবস্থায় আছেন।
ফরচুর শপিং মলের পাইকারি ও খুচরা ফ্যাশন হাউজ আনকারার সত্ত্বাধিকারী রোকেয়া হাসান জানান, অনেক গ্রাহককে ভ্যাট চালানসহ বিল দেওয়া হলে তারা দামাদামি করার চেষ্টা করেন।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানান, কর প্রশাসনের সদর দপ্তর অবগত আছেন যে অসংখ্য ব্যবসায়ী ইএফডি রশিদ দিচ্ছেন না।
তিনি বলেন, "দোকানীরা আমাদেরকে জানায়, তাদের বিক্রি নেই। কিন্তু আমরা যখন কোথাও সরেজমিনে পরিদর্শন করি, তখন তারা তাদের মেশিনগুলো ব্যবহার করে মেমো দেয়। আমরা সেখান থেকে চলে গেলে তারা আবার তা বন্ধ করে দেয়।"
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমতুল মুনিম বলেন, "মানুষকে ইএফডিতে কেনাকাটায় উৎসাহ দিতে লটারির মাধ্যমে পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।"
ভ্যাটদাতারা যেন পণ্য বা সেবা ক্রয়ের সময় ইএফডি মেশিনের চালান ব্যবহার করে প্রতিমাসে অনুষ্ঠিত লটারিতে অংশগ্রহণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখে, এজন্য চালান সংগ্রহ করতে হবে। ইএফডিতে ১০১টি পুরস্কার। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ইএফডি চালানের লটারি ড্র অনুষ্ঠিত হয়। লটারিতে ১ লাখ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন মূল্যমানের ১০১টি পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, "ভ্যাট দিবস ও সপ্তাহ পালনের উদ্দেশ্য ভ্যাট সংগ্রহে জনগণের সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আশা করছি, ভোক্তারা সচেতন হবেন এবং ভ্যাট কর্মকর্তারাও রাজস্ববান্ধব হবেন।"