১১ মাসে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার চেয়ে বেশি পরিশোধ করেছে বেসরকারি খাত
২০২৩ সালের প্রথম ১১ মাসে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তির চেয়ে আগের ঋণের মূল ও সুদ হিসেবে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ৫.২১ বিলিয়ন ডলার বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
অতিরিক্ত ঋণ পরিশোধের কারণে ডলারের তারল্যের ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা জানুয়ারি-নভেম্বর সময়ে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পেয়েছেন ২৩.৭০ বিলিয়ন ডলার; অন্যদিকে ঋণের আসল ও সুদের পরিশোধ করেছেন ২৮.৯২ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০২৩ সালের প্রথম ১১ মাসে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় পতন হয়েছে। এর একটি কারণ হল বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ আসা কমে যাওয়া। এই স্বল্পমেয়াদি ঋণের মাধ্যমে আমদানির খরচ মেটানো হয়। বর্তমানে আমদানি কমে যাওয়ায় এই ঋণের চাহিদা কিছুটা কমেছে।'
ব্যাংকাররা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের সুদের হার বৃদ্ধি এবং মুদ্রাটির দাম ক্রমাগত বাড়ার কারণে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক স্বল্পমেয়াদি ঋণ ব্যাপকভাবে কমেছে।
এছাড়া ঋণ নেওয়ার অন্যান্য খরচও বাড়ছে। এখন বিদেশি ঋণের সুদে ২০ শতাংশ কর দিতে হয়। ঋণের সুদহার ইতিমধ্যে বেড়েছে। করের জন্য বাড়তি ১.৭ শতাংশ যোগ হওয়ায় নিট সুদ ১০.২ শতাংশের ওপর চলে যায়। এত সুদ দিয়ে ঋণ নিতে আগ্রহী নন ব্যবসায়ীরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ গড়ে এসেছে ২.১৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে আগের ঋণ ও সুদ বাবদ পরিশোধ হয়েছে গড়ে ২.৬২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রতি মাসে অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে ৪৭৪ মিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য আরও বলছে, ২০২১ সালে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৩৮ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে পরিশোধ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৬ মিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বেসরকারি ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৫৯৩ মিলিয়ন ডলার।
২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ছিল ১৬.৪১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের নভেম্বর শেষে তা ১১.৯৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট শেষে বাংলাদেশের গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৬.৮২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২-এর একই সময়ে ছিল ৩৩.৯৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ৭.১১ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর শেষে বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২১.৪৪ বিলিয়ন ডলার।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও টিবিএসকে বলেন, 'বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ বেশি করা হতো বায়ারস ক্রেডিটের জন্য। আন্তর্জাতিক সুদহার ব্যাপক বৃদ্ধি ও টাকার মান কমে যাওয়া এই ঋণের পরিমাণ কামিয়ে দিয়েছে। এছাড়া নির্বাচনের আগে বিনিয়োগে নানা অশ্চিয়তা থাকায় ব্যবসায়ীরা আমদানির পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছেন, যা বেসরকারি ঋণ কমার অন্যতম কারণ।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২২ সাল শেষে বৈদেশিক স্বল্পমেয়াদি বায়ার্স ক্রেডিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৯.৫৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের নভেম্বর শেষে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৪৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ ঋণ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।
বর্তমানে ফরেন লোন নিতে হয় সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট-এর (সোফর) সঙ্গে আরও ৩.৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করে নিতে হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সোফর রেট ছিল ৪.৩১ শতাংশ। যদিও ২০২১ ও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এই রেটের পরিমাণ ছিল ১ শতাংশের কম।
সোফর হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদহার নির্ধারণের অন্যতম মাপকাঠি। সোফরের মাধ্যমে শুধু মার্কিন ডলারে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেই সুদহার নির্ধারিত হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে দেশে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বৈদেশিক এসেছে ৩৩.৯৬ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে এসেছে ৩৭.২৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০২৩ সালের ১১ মাসে এসেছে ২৩.৭০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'আগের তুলনায় ডলারের সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এছাড়া ডলারের রেট বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ঋণ পেমেন্টের ঝুঁকির বিষয়টিও দেখছেন। ফলে তারা আরও বেশি ঋণ পরিশোধ করছেন, যা আমাদের পেমেন্টের ভারসাম্য এবং রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।'
তিনি বলেন, ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দায় বেড়ে যাওয়ায় তারা নতুন ঝুঁকি না নিয়ে ঋণ পরিশোধ বেশি করেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে ১১০ টাকা দরে। আমদানিকারকদের কাছে ব্যাংকগুলোর ডলার বিক্রি করার কথা ১১০ টাকায়। যদিও আমদানি বিল এবং আগের ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবসায়ীদের ১২০-১২৪ টাকায় ডলার সংগ্রহ করতে হচ্ছে।