লোহিত সাগর সংকট: ফ্রেইট চার্জ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি রপ্তানিকারকদের জন্য বড় ধাক্কা
লোহিত সাগরের বর্তমান অস্থিরতার কারণে উচ্চ ফ্রেইট চার্জ, বেশি লিড টাইম এবং রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের জন্য কনটেইনারের সংকট তৈরি হয়েছে। এতে বড় ধাক্কার মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা ইতোমধ্যেই পোশাকের ক্রয় আদেশ হারিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন।
লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার কারণে শিপিং কোম্পানিগুলো ভিন্ন পথে পণ্য পরিবহনের কথা উল্লেখ করে সারচার্জ আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় কনটেইনার পরিবহনের ফ্রেইট চার্জ ইতোমধ্যেই অন্তত ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
লোহিত সাগরে এ সংকটের প্রভাবে ফ্রেইট চার্জ আরও ২০–২৫ শতাংশ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে এই রুটে জাহাজ পরিচালনকারী শিপিং কোম্পানিগুলো।
বাতিল হচ্ছে ক্রয় আদেশ
এদিকে কিছু পোশাক রপ্তানিকারক বলেছেন, পণ্য পরিবহনে বিলম্ব ও উচ্চ ফ্রেইট চার্জের কারণে অনেক ক্রেতা ইতোমধ্যে অর্ডার বাতিল করতে শুরু করেছে।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম শনিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চলমান সংকটের কারণে তিনি এখন পর্যন্ত ৬টি অর্ডার হারিয়েছেন। এসব অর্ডার তিনি এক মাস আগে বুক করেছিলেন।
'লিড টাইমের [ক্রয় আদেশের পর থেকে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়] হিসেব দীর্ঘ হওয়ায় শুক্রবার আমি মার্কিন একটি আইকনিক ব্র্যান্ডের কাছ থেকে বড় পরিমাণের একটি অর্ডার হারিয়েছি,' তিনি জানান।
তিনি বলেন, তার ইন্দোনেশিয়ান ফ্যাব্রিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট কনটেইনার ঘাটতির কারণে এটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চালান পাঠাতে পারবে না এবং তাদের তিনদিন সময় বেশি প্রয়োজন।
ফলে এই অর্ডারটি এখন ইন্দোনেশিয়ার একটি কারখানায় যাবে জানিয়ে শোভন বলেন, বর্তমান সংকটের কারণে কিছু ক্রয় আদেশ কেবল একটু অল্প লিড টাইমের সুবিধা পেয়ে ইন্দোনেশিয়া ও চীনে চলে যেতে পারে।
'লোহিত সাগর সংকটের কারণে ইতোমধ্যে অন্তত দুই সপ্তাহ ক্ষতি হচ্ছে ক্রেতাদের। তাই এখন প্রতিটি দিন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই আমার ক্রেতা অর্ডার বাতিল করে আরেকটি প্রতিযোগী দেশে চলে গেছে,' তিনি বলেন।
সামনে আরেকটি কনটেইনার সংকট
টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, লোহিত সাগরের সংঘাত ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনকে ব্যাহত করেছে এবং লিড টাইম বাড়ার ফলে সারাবিশ্বে আরেকটি কনটেইনার সংকট তৈরি হতে পারে।
এ কারণে প্রতিদিনই ফ্রেইট চার্জ বাড়ছে বলে জানান লজিস্টিক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত থাকা তুহিন।
স্প্যারো গ্রুপের শোভন ইসলাম বলেন, সংকট শুধু ইউরোপগামী অর্ডারেই প্রভাব ফেলেনি। অন্যান্য দেশ থেকে আসা ক্রয় আদেশগুলোতেও এ সংকটের ধাক্কা লাগছে। রপ্তানিকারকেরা বিশ্বজুড়েই অর্ডার হারাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ এইচ. এম. মুস্তাফিজ বলেন, সংকটের কারণে ফ্রেইট খরচ প্রতি কনটেইনারে আরও ১,২০০ ডলার করে বেড়েছে — আগে হামবুর্গ বন্দর বা ডেনমার্ক বন্দরের জন্য যা ছিল মাত্র দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৭০০ ডলার।
অন্যদিকে লিড টাইমও ১০ থেকে ১২ দিনের মতো বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কৃষ্ণ সাগরে সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হওয়ার দরুন সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এখনো লড়ছে দেশের অর্থনীতি। লোহিত সাগরে হুট করে তৈরি হওয়া এ নতুন সংকট সরকারের চ্যালেঞ্জকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
বিশ্বের ৫টি প্রধান শিপিং ফার্মের মধ্যে ৪টি — মার্স্ক, হ্যাপাগ-লয়েড, সিএমএ সিজিএম গ্রুপ ও এভারগ্রিন-এর পাশাপাশি বিপি-এর মতো বৃহৎ তেল কোম্পানিও লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে শিপিং স্থগিত করায় শিপিং খরচ এবং তেলের দাম উভয়ই বেড়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ইতোমধ্যে এর ধাক্কা অনুভব করতে শুরু করেছে। কারণ এখানকার স্থানীয় শিপিং এজেন্টরা জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রেইট চার্জ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
২০২৪ সালের শুরু হয়েছিল বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি হ্রাসের সঙ্গে। কিন্তু হুথি লক্ষ্যবস্তুতে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের যৌথ সামরিক জবাবের পর আঞ্চলিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় আশঙ্কায় তেলের দাম ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে ব্যারেল প্রতি ৮০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছে। এর ফলে আবার নতুন করে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে বৈশ্বিক গণমাধ্যমগুলো।
সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে একটি প্রধান শিপিং রুট হলো লোহিত সাগর। এ অঞ্চলে হুথিদের হামলা তীব্র হওয়ার পর থেকে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে ফ্রেইট চার্জ এক মাসে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, লোহিত সাগরে হামলার দরুন বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
'ফ্রেইট চার্জ বৃদ্ধি করোনার সময়ের মতোই লাগামহীন হয়ে পড়তে পারে। ফলে সময়মতো পণ্যের ডেলিভারি নিতে পারবেন না আমদানিকারকেরা। একইভাবে রপ্তানি পণ্যও সঠিক সময়ে পৌঁছাবে না। দ্রব্যমূল্যের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে,' বলেন তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলম্বো, সিঙ্গাপুর, পোর্ট কেলাং, তানজুম পেলাপাস বন্দর পর্যন্ত কনটেইনারপ্রতি ফ্রেইট চার্জ ৩০০ থেকে ৩৫০ ডলার। জাহাজের ইন্স্যুরেন্স, ফ্রেইট খরচ বাড়ার কারণে এই ভাড়া ৫০০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে টিবিএসকে জানিয়েছে একাধিক শিপিং কোম্পানি।
রপ্তানির জন্য বিপদচিহ্ন
লোহিত সাগর এড়িয়ে শিপিং কোম্পানিগুলো আফ্রিকা এবং উত্তমাশা অন্তরীপের চারপাশ দিয়ে তাদের জাহাজ চালাচ্ছে। এতে সমুদ্রযাত্রায় বাড়তি এক থেকে দুই সপ্তাহ যোগ হচ্ছে। সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে যাওয়া কনটেইনার জাহাজগুলোর অন্তত ৯০ শতাংশ এখন আফ্রিকা ঘুরে পণ্য পরিবহন করছে। জার্মানির ওয়ার্ল্ড ইকোনমি'র কিয়েল ইনস্টিটিউট-এর বরাত দিয়ে এপি জানিয়েছে, এর ফলে চীন থেকে উত্তর ইউরোপে একটি ৪০ ফুট আকারের কনটেইনারের জন্য ফ্রেইট চার্জ দেড় হাজার থেকে চার হাজার ডলার পর্যন্ত বেড়েছে।
দ্রুত পরিস্থিতির সমাধান না হলে করোনার সময়ের মতো সরবরাহ চেইন ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করছেন শিপিং খাতসংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে ৪০ ফুট কনটেইনারের ঘাটতির পাশাপাশি মাদার ভেসেল স্লট সংকটও তীব্র হবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন জানান, লোহিত সাগরে জাহাজে হামলার কারণে সমুদ্রপথে ১১ দিন বিলম্ব হচ্ছে।
এতে বাংলাদেশে ৪০ ফুট কনটেইনারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে মাদার ভেসেলের কনটেইনার স্লটের সংকট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৭৫ শতাংশ হয় ৪০ ফুট আকৃতির কনটেইনারে। বাকি ২৫ শতাংশ হয় ২০ ফুট আকৃতির কনটেইনারে। তৈরি পোশাক রপ্তানির বেশিরভাগই হয় ৪০ ফুট কনটেইনারে।
বিকডা মহাসচিব মোহাম্মদ রুহুল আমিন সিকদার টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন ডিপোতে ৪০ ফুট কনটেইনারের ঘাটতি রয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্সের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, লোহিত সাগরে সংকট ইতোমধ্যেই ফ্রেইট খরচ বাড়িয়েছে। যদি অবিলম্বে এটির সমাধান না হয়, তাহলে এটি আমদানি ও রপ্তানি উভয়কেই প্রভাবিত করবে। কারণ সেক্ষেত্রে প্রতিটি জাহাজকে দীর্ঘ বিকল্প পথ পাড়ি দিতে হবে।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'রপ্তানির সময় ক্রেতারা ফ্রেইট খরচ পরিশোধ করেন। তবে এই অতিরিক্ত খরচ আমাদের পণ্যের দামকে প্রভাবিত করতে পারে।'
বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যেই কিছু ক্রেতা তাদের পণ্য আকাশপথে পাঠাতে বলছেন, যা ব্যয়বহুল। তার আশঙ্কা, লিড টাইম কমাতে কিছু ক্রেতা বাংলাদেশে থেকে মুখ ফিরিয়ে চীনে চলে যেতে পারেন।