ব্যাংকগুলোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এক্সটার্নাল অডিটররা বাড়তি ক্ষমতা পাবে
দেশের ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এক্সটার্নাল অডিটর (বহিঃনিরীক্ষক) প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও ক্ষমতা দিয়ে গাইডলাইন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
খসড়া গাইডলাইন অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলধন, প্রভিশনিং ও মুনাফা বাড়াতে 'উইন্ডো ড্রেসিং'-এর আশ্রয় নিয়েছে কি না, তা নিরীক্ষা করতে পারবে এক্সটার্নাল অডিটররা।
এছাড়া অডিটররা ঋণ শ্রেণিকরণ অনিয়ম, বৈদেশিক মুদ্রায় অনিয়ম, মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের তথ্যের সঠিকতা যাচাই, পুনঃতফসিল এবং সুদ মওকুফ-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর রিপোর্টিং করতে পারবে।
এই গাইডলাইনটি 'ব্যাংক-কোম্পানি বহিঃনিরীক্ষণ বিধিমালা, ২০২৪' নামে অভিহিত হবে। তবে এখনও এ গাইডলাইনের চূড়ান্ত অনুমোদন হয়নি। খুব শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারের মাধ্যমে নির্দেশনা জারি করবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন।
টিবিএসের হাতে খসড়া গাইডলাইনটিতে বলা হয়েছে, একটি ব্যাংকে একাধিক এক্সটার্নাল অডিটর প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা করতে পারবে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান পরপর তিন বছরের বেশি নিরীক্ষা করতে পারবে না।
একটি ব্যাংক বাৎসরিকভাবে এক্সটার্নাল অডিটর নির্বাচন করবে এবং প্রতি বছরের আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তিসহ ওই প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত নিয়োগপত্র দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, 'বহিঃনিরীক্ষক নিয়োগের বিধিমালা করাটা একটা ভালো উদ্যোগ। আগে যারা নিরীক্ষা করত, তারা ব্যাংকের ইচ্ছামতো রিপোর্ট দিত।'
এই অর্থনীতিবিদ টিবিএসকে বলেন, 'টাকার ওপর ভিত্তি করে [ব্যাংকগুলোকে] এ, বি, সি, ডি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করত নিরীক্ষকরা। তাই এসব নিরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ব্যাংকগুলোর ঋণ অনিয়ম ও বৈদেশিক মুদ্রার দুর্নীতিগুলো যদি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো উঠিয়ে নিয়ে আসতে পা,রে তাহলে খুবই ভালো হয়। যেহেতু বিধিমালা করা হচ্ছে, সুতরাং তারা আগের চেয়ে ভালোভাবে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, 'বিধিমালা জারি করার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা অনুযায়ী অনেক আগে থেকেই আমরা বহিঃনিরীক্ষকের আইন অনুসরণ করছি। তারা ব্যাংকের ব্যালান্সশিট চেক করে, লভ্যাংশ চেক করে, ঋণ-সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়।
'সেটা আবার বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) ওঠে। এভাবেই চলে আসছে। নতুন করে বিধিমালা জারি করার কারণ কী, তা আমার জানা নেই।'
নতুন এই খসড়া গাইডলাইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের একাধিক বহিঃনিরীক্ষক নিয়োজিত থাকলে প্রধান কার্যালয় যৌথভাবে নিরীক্ষিত হবে। তবে কোন শাখা কোন প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষিত হবে, তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকই ঠিক করবে।
এক্সটার্নাল অডিটর প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর-ভিত্তিক ব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠাবে। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে দাখিল করতে হবে।
এই অডিট প্রতিবেদনে পাঁচ ধরনের প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। সেগুলো হচ্ছে: ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং-সংক্রান্ত অনিয়ম, বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন-সংক্রান্ত অনিয়ম, রেগুলেটরি রিপোর্টিং-সংক্রান্ত অনিয়ম, সিআইবি তথ্য প্রেরণ-সংক্রান্ত অনিয়ম ও মাসিক ভিত্তিতে তারল্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ।
বিশেষ প্রতিবেদন দাখিল
ব্যাংক কোম্পানি আইনের কোনো ধারা লঙ্ঘন হলে ও প্রতারণা-সংক্রান্ত ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলে বা ব্যাংকের সংরক্ষিত মূলধন আবশ্যক মূলধনের ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেলে, আমানতকারীর অর্থ পরিশোধে নিশ্চয়তা বিঘ্নিত হলে, অথবা কোনো গুরুতর অনিয়ম ঘটলে বহিঃনিরীক্ষক অবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ প্রতিবেদনের মাধ্যমে অবহিত করবে।
গোপনীয় প্রতিবেদন
বহিঃনিরীক্ষাকালে অর্থপাচার প্রতিরোধে আইন অনুযায়ী সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং (এসটিআর) ও নগদ লেনদেন রিপোর্টিং (সিটিআর)-সংক্রান্ত কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে বহিঃনিরীক্ষক বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) গোপনীয় প্রতিবেদন দাখিল করবে।
বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন ও ঋণ নিরীক্ষণ
আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্দেশিত বিধি-বিধানের ব্যত্যয় হয়েছে কি না, রপ্তানি বিল ডিসকাউন্টিং/নেগোসিয়েশন/ক্রয় করার ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থায়ন করা হয়েছে কি না, তা অডিট প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা করবে।
ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার জন্য যোগ্য অডিট ফার্মের সংখ্যা এখন ৩১টি।
প্রতি দুই বছর পরপর যোগ্য অডিট ফার্মের তালিকা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছর নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে তালিকা থেকে ২১টি প্রতিষ্ঠান বাদ পড়েছে। তালিকায় নতুন করে জায়গা পেয়েছে পাঁচ অডিট ফার্ম। সবশেষ তালিকা অনুযায়ী এখন যোগ্য অডিট ফার্মের সংখ্যা ৪৭টি থেকে ৩১টিতে নেমেছে।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে বলা হয়েছে ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক সূচকসমূহ পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো ব্যাংকে উক্ত ব্যাংকের নিজ খরচে একাধিক বহিঃনিরীক্ষক নিয়োগের নির্দেশনা দিতে পারবে।
পাশাপাশি ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিধান অনুসারে দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা ব্যর্থতার ক্ষেত্রে বহিঃনিরীক্ষককে অযোগ্য ঘোষণা করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।