আগামী জানুয়ারির মধ্যে একীভূত হতে চাপ দেওয়া হতে পারে অন্তত ১০ ব্যাংককে
খেলাপি ঋণ কমানো এবং ব্যাংকিং খাতে কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার রোডম্যাপের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে কমপক্ষে ১০টি ব্যাংককে চাপ দিয়ে একীভূত করার পরিকল্পনা করছে।
সোমবার (৪ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) নেতৃবৃন্দকে এ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকসহ ৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকেরা অংশ নেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গভর্নর ব্যাংক মালিকদের একীভূত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে এবং তারা কোন ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চান তা ঠিক করতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি পূরণ করা হবে, তাই পরিচালকেরা এই একীভূতকরণের দ্বারা প্রভাবিত হবেন না বলে আশ্বস্ত করেছেন গভর্নর।
দুর্বল ব্যাংকের পাশাপাশি সবল বা ভালো ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে বৃহৎ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক গঠনের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে বলে সভায় ব্যাংক পরিচালকদের পরামর্শ দেন গভর্নর।
বৈঠকে অংশ নেওয়া ওই সূত্র আরও জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর দুই শক্তিশালী বড় বেসরকারি ব্যাংক সিটি ও ইস্টার্ন ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন বড় ব্যাংক গঠন করা যেতে পারে বলে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
সভাশেষে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে একীভূতকরণ নিয়ে যে উদ্বেগ ২০২৩ সালে শুরু হয়েছিল, তা দূর হয়েছে। কারণ এ ধরনের যেকোনো পদক্ষেপের উদ্দেশ্য কেবল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা।
তিনি বলেন, 'গভর্নর আমাদের প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে দিয়েছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি, এতে কারও ক্ষতি হবে না। দুর্বল ব্যাংকগুলো শক্তিশালী হবে এবং ভালো ব্যাংকগুলো আরও ভালো হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিভিন্ন দেশে ব্যাংকের একীভূত হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে। আমরা জাতীয় স্বার্থে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করব।'
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, 'ব্যাংকিং খাতের কল্যাণে আমরা ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করব।'
তিনি বলেন, চলতি বছরের মার্চের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 'এরপর কোন ব্যাংকগুলোকে একীভূত করতে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তারপর সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে প্রণীত নীতিমালার আলোকে প্রক্রিয়া শুরু হবে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরও বলেন, 'আমাদের সামনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ রয়েছে... বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকদের নিজস্ব উদ্যোগে ব্যাংকগুলো একীভূত হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরাও চাই মালিকেরা সিদ্ধান্ত নিন। প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।'
পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমান বলেন, বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর একীভূতকরণ আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী পরিচালিত হবে বলে তাদের আশ্বস্ত করেছেন।
তিনি বলেন, 'দুর্বল ব্যাংক কখনোই শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে চলতে পারে না। যেমন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমাদের ব্যাংক ভালো অবস্থানে আছে। আমাদের সঙ্গে একটি দুর্বল ব্যাংক চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।'
ব্যাংক একীভূতকরণের কর্তৃপক্ষ
ব্যাংক কোম্পানি আইন ২০২৩-এর সর্বশেষ সংশোধনীতে কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা আমানতকারীর স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কার্যকলাপে জড়িত থাকলে যেকোনো ব্যাংককে চাপ দিয়ে একীভূতকরণ শুরু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
এ সংশোধনীর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের ডিসেম্বরে দুর্বল পারফরম্যান্সকারী ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করতে প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক চালু করে।
এটি নতুন কাঠামোর অধীনে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে সেগুলোকে নন-পারফর্মিং ঋণ এবং ঝুঁকিবারিত সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের অনুপাতের (সিআরএআর) ভিত্তিতে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ সম্পর্কে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করে সেখানে উল্লেখ করে, যদি একটি দুর্বল ব্যাংক একটি শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়, তবে একীভূত হওয়ার পরের তিনবছর দুর্বল ব্যাংকের কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হবে না।
রোডম্যাপে আরও উল্লেখ করা হয়, এ একীভূতকরণের লক্ষ্য হলো ব্যাংকগুলোর বোর্ডকে শক্তিশালী করা, মূলধনের ঘাটতি দূর করা এবং পরিচালন ব্যয় কমানো।
ব্যাংকগুলোর অবস্থা
দেশের ব্যাংকিং খাতে ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ খেলাপি মোট ১৬ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের ৯ শতাংশ।
গত বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ৯৩ শতাংশ ছিল মাত্র ১১টি ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ১৪টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় পৌঁছে।
বর্তমানে দেশে ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ৩৪টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। ২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেওয়া ৯টি নতুন ব্যাংকের সবকটিই এখনও ওভারস্যাচুরেটেড বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
এমন একটি ব্যাংক পদ্মা ব্যাংক বর্তমানে পতনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এটি একীভূত হওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে। একই ধরনের আরেক ব্যাংক – এনআরবি গ্লোবাল – গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক নাম নিয়ে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্সের ব্র্যান্ডিংয়ের কারণে নতুন প্রজন্মের বাকি ব্যাংকগুলো এক দশক পরে এসেও বাণিজ্য অর্থায়ন পেতে হিমশিম খাচ্ছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টেনে না নিয়ে তাদের একীভূত করাই বাঞ্ছনীয়।
তিনি বলেন, কোন ব্যাংক একীভূতকরণের আওতায় আসবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সে নির্দেশনা দিতে হবে। 'দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত হতে না চাইতে পারে, কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তাদেরকে জোর করে একীভূত করতে হতে পারে। দুর্বল ব্যাংকগুলো এগিয়ে না এলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা বা তাদের লাইসেন্স বাতিল করা যেতে পারে।'
মনসুর বলেন, আন্তর্জাতিক রীতি হচ্ছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দেয়। যদি একটি সবল ব্যাংক অন্য একটি সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায়, তাও হতে পারে।
'যদি একটি দুর্বল ব্যাংক একটি সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়, তাহলে সরকার একটি অডিট ফার্মের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের ক্ষতির মূল্যায়ন করার পরে সবল ব্যাংকটিকে ক্ষতিপূরণ দেবে। কারণ সবল ব্যাংককে এই মন্দ সম্পদের বিপরীতে আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে,' তিনি আরও বলেন।
'এমন পরিস্থিতিতে দুর্বল ব্যাংকের মালিকানা থাকবে না। সম্পদ গ্রহণের ফলে যে ক্ষতি হবে, তা তাদের পেইড-আপ মূলধন থেকে বাদ যাবে। এরপরও যদি কিছু থেকে যায়, তবেই দুর্বল ব্যাংকের পরিচালকেরা সমতুল্য শেয়ার ধারণ করবেন,' তিনি ব্যাখ্যা করেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একীভূতকরণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগ ২০১৯ সালে একীভূতকরণের একটি নির্দেশিকা তৈরি করে। ওই নির্দেশিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর একীভূতকরণের অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করা হয়।
এশীয় সংকটের পরে মালয়েশিয়ার সরকার ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত হওয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু শেয়ারহোল্ডার ও ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় সরকারে এ আহ্বান সন্তোষজনক সাড়া পায়নি।
এরই মধ্যে আগের সম্ভাবনাময় বছরগুলোতে সম্পদ খাতে অযৌক্তিক পরিমাণে ঋণ দেওয়ার ফলে দেশটির ব্যাংকিং খাতে বিপুল নন-পারফর্মিং ঋণ তৈরি হয় যার ফলে দুর্বল এবং দুর্দশাগ্রস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ে।
এ পরিস্থিতিতে জনস্বার্থ রক্ষা এবং দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে ব্যাংক নেগারা মালয়েশিয়াকে (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) একটি ব্যয়বহুল উত্তরণ প্রকল্প গ্রহণ করতে হয়েছিল।
যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একীভূতকরণ বা বন্ধের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর পরামর্শ দিয়েছিল, সরকার বিশাল সামাজিক ব্যয় বিবেচনা করে ব্যাংক বন্ধ করার কথা চিন্তা করেনি।
বরং মালয়েশিয়ার সরকার নীতিবদ্ধ একীভূতকরণের পথ বেছে নেয় এবং জড়িত সকল পক্ষের ন্যায্যতার নীতি বজায় রেখে সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করে।
এ প্রক্রিয়ায় অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের হওয়া ক্ষতি কর প্রণোদনা দিয়ে পূরণ করা হয়েছিল। তারপরও দেশটির সরকারের একীভূতকরণের এই আর্থিক ব্যয় দুর্বল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেলআউট করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব ব্যয়ের চেয়ে কম ছিল। ২০১০ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়া ৫৪টি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে কমিয়ে ১০টি বড় অ্যাংকর ব্যাংকে পরিণত করে।
ভারত
ভারতে ১৯৬৯–১৯৯০ সালে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে মোট ১২টির বাধ্যতামূলক একীভূতকরণ ঘটেছিল। ১৯৯১–২০১০ সালের মধ্যে দেশটিতে ২২টি ব্যাংক একীভূত হয়, যার মধ্যে ১১টি ছিল স্বেচ্ছায় একীভূতকরণ। দুর্বল ব্যাংকের পুনর্গঠনের জন্য অন্য ১১টির বাধ্যতামূলত একীভূতকরণ করা হয়।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের আইডিএফসি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক কোম্পানি ক্যাপিটাল ফার্স্ট একীভূত হয়ে আইডিএফসি ফার্স্ট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত হয়।
থাইল্যান্ড
আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে থাইল্যান্ডে সরকার দ্রুত ৫৬টি আর্থিক কোম্পানিকে একীভূত করে। কোম্পানিগুলোর কার্যকরী সম্পদের দখল নিতে একটি নতুন ব্যাংকও (রাদানাসিন) প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ব্যাংকটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সরকার ছয়টি বেসরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেগুলোকে একীভূত করে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিণত করে।
১৯৯৮ সালে থাই সরকার একটি ব্যাংকের মন্দ সম্পদ একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিতে হস্তান্তর করে ব্যাংকটি বন্ধ করা, একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক দিয়ে একটি দুর্বল ব্যাংককে অধিগ্রহণ করা এবং একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার মতো বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছিল।