প্রকল্প অফিস থেকে রিসোর্ট—যেভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে কনটেইনার হাউজ
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/03/16/p-5-high.png)
নানা সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যের কারণে গত কয়েক বছরে অস্থায়ী বাড়ি তৈরির জন্য চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পুরনো শিপিং কনটেইনারের চাহিদা বেড়েছে।
লোহার তৈরি পুরনো কনটেইনার দিয়ে একসময় শুধু কাভার্ড ভ্যান বানানো হতো। কিন্তু সেই পরিস্থিতি বদলে গিয়ে এখন এসব পুরনো কনটেইনার দিয়ে অস্থায়ী প্রকল্প অফিস, স্টাফ কোয়ার্টার ও রিসোর্ট তৈরি করা হচ্ছে।
এসব লোহার কনটেইনার হাউজ বানাতে ইট, বালি, রড, সিমেন্টের প্রয়োজন হয় না। লাগে না কোনো কাঠ বা বাঁশ। তাই পরিবেশের ওপর নতুন করে কোনো চাপ সৃষ্টি না করায় এসব ঘর পরিবেশবান্ধব। এসব ঘর বানাতে সময় যেমন কম লাগে, তেমনি দামেও সাশ্রয়ী।
এছাড়া এসব কনটেইনার হাউজ রেডিমেড পাওয়া যায়, অথবা মাত্র এক সপ্তাহে বানানো যায়। এসব ঘর প্রয়োজনে খুব সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরও করা যায়। আবার প্রয়োজন শেষে ভালো দামে বিক্রিও করা যায় ঘরগুলো।
এসব নানা সুবিধার কারণে সম্প্রতি দেশে কনটেইনার দিয়ে ঘর বানানোর দিকে ঝুঁকছেন অনেকে। ফলে এসব ঘরের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি কারখানা।
কনটেইনার হাউজের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও আউটার রিং রোডের আশপাশে গড়ে উঠেছে আটটির মতো কারখানা।
একেকটি কনটেইনার হাউজ গুণগত মান ও নকশাভেদে বিক্রি হয় ২ থেকে আড়াই লাখ টাকায়।
আটটি কারখানাথেকে প্রতি মাসে গড়ে ৩০টির মত কনটেইনার হাউজ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। শুধু অফিস বা থাকার ঘর নয়, কেউ কেউ রিসোর্ট বানানোর জন্যও নিয়ে যাচ্ছেন এসব কনটেইনার হাউজ।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শায়লা শারমিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যেকোনো জিনিসের রিইউজ ও রিসাইকেল পরিবেশবান্ধব। কনটেইনার দিয়ে ঘর বানালে তা পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি নির্মাণ সময় ও খরচ দুটোই বাঁচায়।'
তিনি জানা, কনটেইনার দিয়ে ঘর বানানোর প্রক্রিয়াকে স্থাপত্যবিদ্যার ভাযায় মডিউলার হাউজিং বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই মডিউলার হাউজিংয়ের প্রচলন আছে। সহজে মডিফাই করে প্রয়োজনে দোতলা থেকে তিনতলা ঘরও কনটেইনার দিয়ে বানানো সম্ভব।
'এর বিম ও স্ট্রাকচার স্টিল দিয়ে বানানো বলে প্রথাগত বাড়িগুলোর তুলনা এগুলো তুলনামূলক মজবুত হয়। লোহার তৈরি পুরনো কনটেইনার ব্যবহার করে এই ঘর বানানো হয় বলে ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা দুর্যোগের সময় সাধারণ ঘরের চাইতে বেশি নিরাপত্তা দেয়,' বলেন তিনি।
শায়লা আরও বলেন, ছোট পরিবারের বসবাস, ভ্যাকেশন হাউজ, রিসর্টের রেসিডেন্সিয়াল স্যুট, সাইট অফিসসহ বিবিধ ব্যবহারের জন্য এসব ঘর বেশ উপযোগী।
বাংলাদেশের মতো দেশে কনটেইনার মডিউল হাউজিং বেশ কার্যকর এবং এই খাতের ভবিষ্যৎ বেশ সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন এই স্থপতি।
সম্প্রতি ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ডের বাংলাবাজার এলাকায় অবস্থিত একটি কারখানায় কনটেইনার হাউজ কিনতে আসেন অনন্ত উজ্জ্বল। এই ক্রেতা বলেন, 'ঢাকার অদূরে আমারা একটি ইকো-রিসোর্ট গড়ার পরিকল্পনা করছি, যেখানে কটেজগুলো হবে কনটেইনার দিয়ে তৈরি। এগুলো তৈরিতে সময় যেমন কম লাগবে, তেমনি খরচও কম হবে।'
উজ্জ্বল জানান, শুরুতে বাথরুম ও ছোট্ট একটি রান্নাঘর এবং থাকার জায়গাসহ ১০টি কনটেইনার কটেজ দিয়ে রিসোর্টটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
উজ্জ্বল যেখান থেকে কনটেইনার কিনতে এসেছেন, ওই কারখানার মালিক অরুপ রতন চক্রবর্তী বলেন, 'বিভিন্ন প্রকল্পের মালামাল আমদানির পর খালি কনটেইনারগুলো নিলামে বিক্রি করে দেয় কর্তৃপক্ষ। আমরা ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে কনটেইনারগুলো কিনে নিয়ে আসি ডিপোতে।'
এরপর গ্রাহকদের পছন্দমতো নকশায় দরজা ও জানালা কেটে রং করে ভেতরে স্টিল ফ্রেম বসানো হয়। পরে তাপ ও আগুন-প্রতিরোধী গ্লাসউইল ইনসুলেশন দিয়ে ইলেকট্রিক ওয়্যারিং করা হয়।
সবশেষে দেয়ালে মেলামাইন বোর্ড, সিলিংয়ে জিপসাম বোর্ড ও মেঝেতে গ্রাহকের পছন্দমতো কার্পেট বা ফ্লোরম্যাট লাগিয়ে প্রস্তুত করা হয় ঘর। এছাড়াও চাহিদামতো বাথরুম ও কিচেন সংযোজনের কাজও করা হয় বলে জানান অরুপ রতন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একসময় শুধু অফিসঘর বানানোর জন্য এসব ঘর ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে গ্রামে থাকার জন্য ও রিসোর্ট বানানোর জন্য অনেকে এগুলো নিয়ে যাচ্ছেন। তবে বড় ক্রেনে করে এসব ঘর পরিবহন করতে হয় বলে অনেকে চাইলেও পর্যাপ্ত প্রশস্ত সড়ক না থাকায় এগুলো নিয়ে যেতে পারছেন না।
চট্টগ্রামের আরেকটি কারখানার মালিক আবুল বশর বলেন, 'পুরনো কনটেইনার দিয়ে একসময় শুধু কাভার্ড ভ্যান বানানো হতো। বর্তমানে দেশে বড় বড় যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সেগুলোর ঠিকাদাররা আমাদের মূল ক্রেতা।
'প্রকল্প শেষে সেসব কনটেইনার হাউজ আবার ভালো দামে আমাদের কাছে বিক্রি করে দেন তারা। তবে ইদানীং গ্রামে থাকার জন্যও অনেকে এসব কনটেইনার হাউজ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।'
বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও সাশ্রয়ী কনটেইনার হাউজের জনপ্রিয়তা বাড়ানো গেলে তা গ্রামীণ আবাসন খাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করছেন কারখানা মালিকরা।