গরুর মাংস রহস্য: সব জায়গায় এক দামে বিক্রি হচ্ছে না কেন?
ঢাকার বিভিন্ন বাজারে বিভিন্ন দামে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। কোনো বিক্রেতা প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি করছেন ৫৯৫ টাকায়, আবার কেউ কেউ বিক্রি করছেন ৭৫০ টাকায়। এতে কিছু দোকান কীভাবে এত কম দামে মাংস বিক্রি করেও লাভ করতে পারছে, এ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
রাজধানীর মালিবাগ এলাকার মাংসের দোকান খোরশেদ গোশত বিপণী। দ্য বিজনেসে স্ট্যান্ডার্ড সরেজমিনে দেখতে পেল, দোকানটিতে একইসঙ্গে দুই দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে—৭৫০ এবং ৬০০ টাকা কেজি দরে।
দোকানের একপাশে গরুর বিভিন্ন অংশের মাংস ঝুলিয়ে রাখা; সেখান থেকে পছন্দ অনুযায়ী কেনার সুযোগ রয়েছে। তবে দাম ৭৫০ টাকা কেজি।
অন্যপাশে পিস করে কাটা বিভিন্ন অংশের মাংস একসঙ্গে বিক্রি করা হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি দরে। এখানে অবশ্য ক্রেতার সংখ্যা বেশি, যাদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রমজানে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করেই ৬০০ টাকায় মাংস বিক্রি করছে দোকানটি। সাশ্রয়ী মূল্যে দেওয়ায় মাংস বিক্রি হচ্ছে তুমুল।
দোকানের কর্মচারীরা জানালেন, সকাল থেকে দোকানটিতে মোট ১৪টি (দুপুর দেড়টা পর্যন্ত) গরু বিক্রি শেষ পর্যায়ে। আরও চারটি গরু জবাইয়ের জন্য রাখা আছে, যা শেষ হলে আরও নিয়ে আসা হবে।
৬০০ টাকায় মাংস বিক্রি করে লোকসান গুনছেন কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে দোকানটির সুপারভিশনের দায়িত্বে থাকা জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, 'দুই দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু কোনোটিতেই লস নেই। মূলত উচ্চ থেকে নিম্ন আয়ের সব ক্রেতাকে টানতেই এই পদ্ধতি।'
অন্যদিকে উত্তর শাহজাহানপুরের আরেক মাংস বিক্রেতা খলিলুর রহমান প্রথম রোজা থেকেই ৫৯৫ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছেন। শুধু কম দামের কারণেই দিনে কোটি টাকার মাংস বিক্রি করছেন এই বিক্রেতা।
রবিবার খলিল গোস্ত বিতানের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এই সুযোগে পাশের মাংসের দোকান হালাল মিটে বেশ ভিড় দেখা গেল বিকেল পৌনে ৪টার দিকেও। কেউ কেউ আধঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও মাংস কিনতে না পেরে বিরক্তি প্রকাশ করছেন। তবে দোকানটিতে মাংস বিক্রি করা হচ্ছে ৭৫০ টাকায়।
পাশের এক দোকানি জানালেন, সকালে দোকানটিতে ৭২০ টাকায় মাংস বিক্রি করা হয়েছে। খলিলের দোকান বন্ধের কথা জানার পর তারা নতুন দাম ৭৫০ টাকা নির্ধারণ করেছেন।
খোরশেদ ও খলিলুরের মতো যেসব ব্যবসায়ীরা খুচরা পর্যায়ে ৬০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছেন, তারা মাংস বড় টুকরো করে বিক্রি করেন না। এর পরিবর্তে তারা মাংসকে ছোট ছোট টুকরো করে হাড় ও মাংস একসাথে মিশিয়ে বিক্রি করেন।
খলিলুর রহমান টিবিএসকে বলেন, ৬০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করে লাভ কম হয়। তবে কম দামে বেশি বিক্রি করার ফলে তাদের সার্বিক লাভও বেশি হয়।
ঢাকায় কিছু ব্যবসায়ী কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করলেও সেটা সংখ্যার বিচারে কম। তবে তাদের কেউই লোকসান গুনছেন না। কম লাভে বেশি বিক্রি করে মুনাফা বৃদ্ধিই তাদের ব্যবসায়িক পদ্ধতি।
অন্যদিকে ঢাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দরে গরুর মাংস বিক্রি করছেন।
বনশ্রীর স্বপন নামে এমনই এক ব্যবসায়ী ৭৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছিলেন। তিনি বলেন, 'প্রতিদিন দুইজন কর্মচারীর খরচ আর দোকান ভাড়া মিলিয়ে ৬০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করা আমাদের জন্য টেকসই নয়। কারণ আমরা এক বা দুটির বেশি গরু বিক্রি করতে পারছি না।'
বেসরকারি বিক্রেতাদের পাশাপাশি প্রথম রোজা থেকেই সরকার ২৫টি স্পটে ৬০০ টাকায় এবং ৫টি স্পটে ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছে। পরিমাণে খুব বেশি না হলেও প্রতিদিন আড়াই হাজারের মতো মানুষ এসব অস্থায়ী দোকান থেকে মাংস কিনতে পারছেন।
এর চাপটা অল্প হলেও অন্য বিক্রেতাদের ওপর পড়েছে। সে কারণে প্রথম রোজায় বেশিরভাগ জায়গায় ৭৮০ টাকা দরে মাংস বিক্রি করতে দেখা গেলেও এখন সেটা ৭৫০ তাকায় নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও বিক্রেতারা ৭২০-৭৩০ টাকাতেও বিক্রি করছেন।
৭৫০ টাকায় গরুর মাংস, কতটা যৌক্তিক?
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ১৫ মার্চ গরুর মাংসসহ ২৯টি পণ্যের সঙ্গে সর্বোচ্চ খুচরা দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংসের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছে ৬৬৮.৩৯ টাকা।
অধিদপ্তর বলছে, এক কেজি গরুর মাংসের উৎপাদন খরচ ৫৮৭.৫০ টাকা। যৌক্তিক লাভ হিসাব করে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মাংসের দাম ৬৬৪.৩৯ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হাতেগোনা দু-চারটি দোকান ছাড়া বেশিরভাগ মাংস ব্যবসায়ীই এই নির্ধারিত দামে মাংস বিক্রি করছেন না।
সরকারনির্ধারিত দাম অনুযায়ী, এক কেজি মাংসের যে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি উৎপাদন খরচ থেকে ৭৭ টাকা বেশি। তবে যারা ৭৫০ টাকায় মাংস বিক্রি করছেন, সেটি উৎপাদন খরচ থেকে ১৬৩ টাকা বেশি এবং নির্ধারিত সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্যের চেয়ে ৮৬ টাকা বেশি।
ব্যবসায়ী ও খামারিরা বলছেন, একেকটি উৎসবকে কেন্দ্র করে গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধিটা ব্যবসায়ীরা এক ধরনের উৎসব মনে করেন। কিন্তু উৎসব করতে করতে দামটা এমন একটা পর্যায়ে গেছে যা বেশিরভাগ সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে যারাই কম দামে মাংস বিক্রি করছে, সেখানেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
সারা দেশের গরুর খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) নেতারা বলছেন, গরুর মাংসের দামটা এত বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। এখানে মাংস বিক্রেতারা অতি মুনাফা করছেন। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সামনে বিপদে পড়তে হবে।
বিডিএফএর সভাপতি মো. ইমরান হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'বাজারে যে দামে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে, তা হওয়ার কথা নয়। কারণ গরুর দাম খামারি পর্যায়ে স্বাভাবিক রয়েছে। যেমনটা ছিল ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে, যখন ঢাকায় একযোগে ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখনকার দামটা কোনোভাবেই যৌক্তিক তো নয়ই, বরং অনেকটাই বেশি।'
তিনি বলেন, 'মাংস ব্যবসায়ীরা বাজারটাকে সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন, আরও একটা ধাপ ওপরে উঠলে মাংসের ক্রেতা একেবারেই তলানিতে নামবে। তখন কিছু আমদানিকারক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে। তারা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করবে যে কম দামে মাংস আমদানি করার সুযোগ দিলে এই অবস্থা থাকবে না।
'কিন্তু যখনই আমদানির সুযোগ দেয়া হবে, তখন দেশের যে লাইভস্টক খাত গড়ে উঠেছে, সেখানে খামারি এবং ভোক্তা দুই গ্রুপই লোকসান গুনতে শুরু করবে।'
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মোর্তুজা টিবিএসকে বলেন, 'মাংসের দাম এত বেশি হওয়া উচিত নয়। ব্যবসায়ীরা অনেকটাই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছেন, তারা এখন আর সমিতির সিদ্ধান্ত মানতে চান না।'
কৃষি বিপণন আইন ২০১৮-রধারা ৪-এর ক্ষমতাবলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি বাজার মনিটরিং করতে পার না। মনিটরিং করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।