‘পদ্মায় জাল ফেলেছে এক্সিম ব্যাংক, এখন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরার পালা’
এক্সিম ব্যাংক ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)-এর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছেন, 'পদ্মায় জাল ফেলেছে এক্সিম ব্যাংক। এখন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরার পালা।'
সোমবার (১৮ মার্চ) বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের একীভূতকরণ বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর এ মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ও পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আফজাল করিমের উপস্থিতিতে দুই ব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষর শেষে পদ্মা ব্যাংকের এক হাজার ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারাবেন না বলেও আশ্বস্ত করেছেন তিনি।
পদ্মা ব্যাংকের যেকোনো ব্যক্তিগত আমানতকারী দ্রুতই এক্সিম ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন বলে জানিয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার।
এ একীভূতকরণের ফলে পরিচালনা পর্ষদের সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেবেন এক্সিম ব্যাংকের পরিচালকেরা। তবে দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
খেলাপি ঋণ কমাতে ও ব্যাংকখাতে সুশাসন নিশ্চিত করার রোডম্যাপের অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের জানুয়ারি নাগাদ অন্তত ১০টি ব্যাংককে চাপ দিয়ে একীভূত করার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
গত ৪ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিএবি-এর নেতৃবৃন্দকে এ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ব্যাংক মালিকদের একীভূত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে এবং তারা কোন ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চান তা ঠিক করতে নির্দেশনা দেন।
সে সময় সভাশেষে বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, 'ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে একীভূতকরণ নিয়ে যে উদ্বেগ ২০২৩ সালে শুরু হয়েছিল, তা দূর হয়েছে। কারণ এ ধরনের যেকোনো পদক্ষেপের উদ্দেশ্য কেবল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা।'
জাতীয় স্বার্থে একীভূত হওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন জানিয়ে তখন নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'গভর্নর আমাদের প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে দিয়েছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি, এতে [একীভূতকরণের ফলে] কারও ক্ষতি হবে না। দুর্বল ব্যাংকগুলো শক্তিশালী হবে এবং ভালো ব্যাংকগুলো আরও ভালো হবে।'
সোমবার (১৮ মার্চ) পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করার জন্য সরকারের কোনো চাপ ছিল না উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, 'তবে সরকারের পক্ষ থেকে পরামর্শ ছিল। আমরা এটা করেছি দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে।'
এক বছরের মধ্যে পদ্মা ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাওয়ার প্রত্যয় জানিয়ে তিনি বলেন, 'পদ্মায় জাল ফেলেছে এক্সিম ব্যাংক, এখন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরার পালা।' দেশে স্বেচ্ছায় দুই ব্যাংকের একীভূত হওয়ার দৃষ্টান্ত এটাই প্রথম।
'চাইলে পদ্মা ব্যাংকের যেকোনো ব্যক্তিগত আমানতকারী তার টাকা এক্সিম ব্যাংক থেকেই তুলে নিতে পারবেন। আর ব্যাংকের সকল দায়ভার এখন থেকে এক্সিম ব্যাংক গ্রহণ করল,' নজরুল ইসলাম বলেন।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, 'মার্জার [একীভূতকরণ] প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করবে। এরপর থেকে তারা একত্রে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এ প্রক্রিয়ার পরেই পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীরা এক্সিম ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন।'
একীভূত হওয়ার পরে পদ্মা ব্যাংকের নাম আর থাকবে না। নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, 'আগামীকাল থেকে আর পদ্মা ব্যাংক থাকছে না। ব্যাংকটিকে একীভূত করার কারণে নতুন কার্যক্রম চলবে এক্সিম ব্যাংকের নামে।
'একীভূত করা হলেও কোনো কর্মী চাকরি হারাবেন না। তবে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালকেরা এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন না। তবে দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।'
এর আগে গত ১৪ মার্চ সকালে ব্যাংকের পর্ষদ সভায় পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডকে অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এক্সিম ব্যাংক।
দ্য ফারমার্স ব্যাংক নামে ২০১৩ সালে পদ্মা ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। এরপর ২০১৭ সালে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। কিন্তু শুরু থেকেই ব্যাপক অনিয়মের কারণে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়।
ব্যাংকটিকে বাঁচাতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশান অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেয়।
সার্ব-অডিনেট বন্ড জারি ও স্থায়ী আমানত রাখার মতো অন্যান্য সহায়তার আকারেও প্রায় এক হাজার কোটি টাকা পদ্মা ব্যাংকে বিনিয়োগ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
কিন্তু পদ্মা ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারায় সহায়তা দিয়েও ব্যাংকটির মূলধন ক্ষয় ঠেকানো যায়নি। ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই তিন হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
বিপুল খেলাপি ঋণ, গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে না পারা এবং বড় লোকসান দিতে থাকায় ২০২১ সালের জুলাইয়ে পদ্মা ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরু পদ্মা ব্যাংককে যেকোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ (মার্জার) বা অধিগ্রহণ (অ্যাকুইজিশন) করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব দেন। কিন্তু মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন তখন হয়নি।
এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পদ্মা ব্যাংক জানায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে ব্যাংকটি। বলা হয়, ব্যাংকটিতে ৭০ কোটি ডলার বিনিয়োগ আনতে ডেল মরগান মধ্যস্থতা করবে। কিন্তু সেই অর্থও কখনো আসেনি।
এদিকে বিনিয়োগ করে পাঁচ বছর পরেও কোনো রিটার্ন না পাওয়ায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদ্মা ব্যাংক থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় আইসিবি। রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ সংস্থাটি এখন তাদের পদ্মা ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির জন্য দেশি-বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারীর সন্ধান করছে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ খেলাপি মোট ১৬ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের ৯ শতাংশ।
গত বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ৯৩ শতাংশ ছিল মাত্র ১১টি ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ১৪টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় পৌঁছে।
বর্তমানে দেশে ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ৩৪টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। ২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেওয়া ৯টি নতুন ব্যাংকের সবকটিই এখনও ওভারস্যাচুরেটেড বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন ২০২৩-এর সর্বশেষ সংশোধনীতে কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা আমানতকারীর স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কার্যকলাপে জড়িত থাকলে যেকোনো ব্যাংককে চাপ দিয়ে একীভূতকরণ শুরু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।