বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৪৩ শতাংশ, ৮ মাসে ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ ২০০ কোটি ডলারের ঘর ছাড়িয়েছে। ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়াই যার পেছনে কাজ করেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ- ইআরডির প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সুদ ও আসল বাবদ আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের প্রায় ২০৩ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। গত অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ১৪২ কোটি ডলার। সে তুলনায় এই বৃদ্ধি বেশ লক্ষণীয়।
ঋণ পরিশোধের ব্যয় এতটা বাড়ার পেছনে সুদ পরিশোধই মূলত ভূমিকা রাখছে, আট মাসে সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৮০ কোটি ৬০ লাখ ডলার (৮০৬ মিলিয়ন)। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৪০ কোটি ৩০ লাখ ডলার সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়, যার তুলনায় এটি দ্বিগুণ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা সংকুচিত হচ্ছে, কারণ বৈদেশিক ঋণের একটি অংশ ব্যবহার হচ্ছে আগের ঋণ পরিশোধে। আগামীতে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে, এজন্য পাইপলাইনে থাকা প্রকল্পগুলো পুনঃপর্যালোচনা করতে হবে। বাস্তবায়নের মেয়াদ এবং অর্থনীতিতে এর প্রত্যাশিত সুফল আদৌ মিলবে কিনা– এসব বিষয় বিবেচনা করে প্রকল্প বাছাই করতে হবে।
এছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার জন্য ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতে রাজস্ব, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তাঁরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, একদিকে বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, আবার ঋণ পরিশোধ বাড়ছে। ফলে নেট ফাইন্যান্সিং কমে যাচ্ছে। আগে নেওয়া বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের নতুন বৈদেশিক ঋণের একটা অংশ চলে যাচ্ছে পরিশোধে।
জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো প্রতিষ্ঠান থেকে আগে নেওয়া ঋণের কাঠামোর বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে, এসব ঋণের ৩০ বছরের মেয়াদ এবং পরিশোধের সময়সূচী (এমোটাইজেশন) তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এসব ঋণের এমোটাইজেশন শেষের দিকে বেশি পরিশোধ করা হয়। যদিও এসব ঋণ কিন্তু আগে সস্তায় দীর্ঘমেয়াদে নেওয়া হয়েছিল। তবে এমোটাইজেশন সিডিউল অনুযায়ী প্রথম দিকে কম পরিমাণ শোধ দিতে হয়, এবং সময় যত গড়ায় ততোই বেশি পরিশোধ করতে হয়।"
"এখন বিশ্বব্যাপী সুদহার বেশি। এখন বিশ্বব্যাংক, এডিবির যে ঋণ সস্তায় পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, সেগুলো আগে ব্যবহার করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ঋণ স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করতে হবে। কঠিন শর্তের বাজার-ভিত্তিক ঋণ এখন কম ব্যবহার করা উচিত। যেমন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)-র পুরোটাই বাণিজ্যিক ঋণ, এটা কম নেওয়া দরকার। এডিবি বাজার-ভিত্তিক ঋণ বেশি দিলেও, তা পরিশোধের লম্বা সময় পাওয়া যায়। আমাদের দেখা উচিত, দীর্ঘ পরিশোধ সময়ের মধ্যে যতটা সস্তায় ঋণ পাওয়া যায়, সেই চেষ্টা করা," বলেন তিনি।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, "এখানে মূল কথা হলো– আমরা যে উদ্দেশ্যে ঋণ নিচ্ছি, সেটা জাস্টিফায়েড বা যৌক্তিক কিনা। ঋণ করে যে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, অর্থনীতিতে ওই সব প্রকল্পে উপযোগিতা আছে কিনা– তা ভাবতে হবে। এটাই হলো মূল বিষয়। আমাদের প্রকল্প বাছাই করতে এবং বাস্তবায়নে ক্রটি থাকলে– সস্তা ঋণও বোঝা হয়ে যায়। এতে করে সেটাও যে অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।"
তিনি উল্লেখ করেন, "বৈদেশিক ঋণ নিয়ে 'ভ্যানিটি' প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যৌক্তিক হয় না। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর প্রকল্পটিও এরকম একটি ভ্যানিটি প্রকল্প ছিল। আমাদের কর্ণফুলী টানেলও একটি ভ্যানিটি প্রকল্প।"
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুবিবেনার মাধ্যমে প্রকল্প বাছাইয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব প্রকল্প উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করবে, সেসব প্রকল্প নিতে হবে। বিশেষ করে, রপ্তানি উৎপাদনশীলতা বাড়বে এমন প্রকল্প বাছাই করতে হবে। সেগুলোর মাধ্যমে ডলার আসবে। এ কারণে লজিস্টিকস ব্যবস্থার উন্নয়নে, জ্বালানি সরবরাহ সংক্রান্ত প্রকল্প– যেগুলো বৈদেশিক মুদ্রা বাড়াতে সরাসরি অবদান রাখবে– সেসব প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
জাহিদ হোসেন বলেন, "যে ঋণে দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধের সুযোগ রয়েছে, সে ধরণের ঋণ নিতে হবে। এছাড়া পাইলাইনে যেসব প্রকল্পের জন্য ঋণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, সেগুলো পুনঃমূল্যায়ন করা দরকার। যেসব প্রকল্প অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখবে সেগুলো বাদ দেওয়া উচিত, এবং এই ঋণ রি-প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে অবদান রাখবে এমন প্রকল্পই নিতে হবে।"
গবেষণা সংস্থা– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বৈদেশিক ঋণের পরিশোধ দ্রুত বেড়েছে। এটা এখন আমাদের জন্য এখন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন মূল কারণ হলো- আমরা কিছু ঋণ নিয়েছি, যা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নয়। এগুলোর পরিশোধের সময় কম এবং বাজার-ভিত্তিক সুদে নেওয়া হয়েছে।
এখন আবার বাজার-ভিত্তিক সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার চীন ও রাশিয়ার মতো দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের কঠিন শর্তের ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়িয়েছে। "যেমন রাশিয়ার রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কিংবা চীনের অর্থায়নে পদ্মা রেলসেতু প্রকল্প। পদ্মাসেতু থেকে কোনো রিটার্ন আসবে না। রূপপুর প্রকল্প থেকে কবে বিদ্যুৎ আসবে তাও বলা যায় না"- তিনি বলছিলেন।
মনসুর বলেন, যমুনা নদীতে সেতু হচ্ছে, কিন্তু দুই পাশে ডাবল লাইন করার টাকা সরকারের নেই। তার মানে, সেতু প্রায় হয়ে যাচ্ছে– কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণের টাকা সরকারের নেই। ফলে প্রত্যাশিত সুফল আসবে না।
"এ মুহুর্তে আমাদের রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে নজর বেশি দিতে হবে। এবং ডলার কেনার জন্য রাজস্ব আহরণও বাড়াতে হবে। এখন আমাদের টাকাও নেই– ডলারও নেই," তিনি যোগ করেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু জাপান বা বিশ্বব্যাংকের মতো যারা সহজ শর্তে সস্তা ঋণ দেয়, তাদের থেকে ঋণ নেওয়া উচিত। যেসব অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের এখনো বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়নি, সেসব প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা নেওয়ার বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সুদহার কেন বাড়ছে
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট (সোফর) বেড়েছে। বর্তমানে সোফর রেট ৫ শতাংশের বেশি। যা এই যুদ্ধের আগে ১ শতাংশের কম ছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের বাজার-ভিত্তিক ঋণ ক্রমগত বাড়ছে। এই কারণে বাংলাদেশকে এখন সুদ বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে যে ঋণ পায় তার প্রায় ৭৫ শতাংশ বাজার-ভিত্তিক ঋণ। এছাড়া, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে বাজার-ভিত্তিক সুদে ঋণ নেয়। এছাড়া বিশ্বব্যাংক থেকে স্বল্প পরিসরে বাজার-ভিত্তিক ঋণ নেওয়া হয় বলেও জানান কর্মকর্তারা।
ঋণ প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৩০৪ শতাংশ
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ প্রতিশ্রুতি ৩০৪ শতাংশ বেড়েছে। উন্নয়ন সহযোগীরা এসময়ে ৭২০ কোটি ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৭৮ কোটি ডলার।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, এবার ঋণ গ্রহণের জন্য যেসব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিতে যেতে হয়, সে প্রস্তুতি ভালো ছিল। এ কারণে অর্থবছরের শুরু থেকে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অনেক প্রকল্পের ঋণচুক্তি করা সম্ভব হয়েছে। সে তুলনায়, আগের অর্থবছরে প্রস্তুতির অভাবে শুরুর দিকে অনেক প্রকল্পের ঋণচুক্তি করা সম্ভব হয়নি।
চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে ৯৯২ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে বলেও জানান তাঁরা।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে এডিবির কাছ থেকে। এই সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া গেছে ২৬২ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি। এছাড়া জাপানের কাছ থেকে ২০২ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ১৪১ কোটি ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
অর্থছাড় বেড়েছে ২ শতাংশ
ইআরডির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বৈদেশিক অর্থছাড় হয়েছে ৪৯৯ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে অর্থছাড়ের পরিমাণ ছিল ৪৮৭ কোটি ডলার।
এই সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে এডিবি। এই সংস্থা অর্থছাড় করেছে ১৩০ কোটি ডলার। জাপান ছাড় করেছে ১০৪ কোটি ডলার। এরপরে বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ৮৭ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। এছাড়া রাশিয়া ৮০ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং চীন ৩৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার ছাড় করেছে।
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের প্রক্ষেপণ
গত অর্থবছরে (জুলাই-জুন) বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের পরিশোধ করেছে ২৬৭ কোটি ডলার। এরমধ্যে সুদ হিসেবে পরিশোধ করেছে ৯৩ কোটি ৫৬ লাখ, আর আসল পরিশোধ করেছে ১৭৩ কোটি ডলার।
ইআরডির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে পরিশোধ বেড়ে হবে ৩৫৬ কোটি ডলার। আগামী দুই অর্থবছরে তা আরো বেড়ে হবে যথাক্রমে ৪২১ কোটি এবং ৪৭২ কোটি ডলার।