১০ মাসে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাজেট বরাদ্দকে ছাড়িয়ে গেছে
বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় ইতিমধ্যে বিদায়ী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটকে ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাময়িক তথ্য অনুসারে, সরকার চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সুদ পরিশোধে প্রায় ১.১৫ বিলিয়ন ডলার (১২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকার সমতুল্য) ব্যয় করেছে।
এই সময়ে সরকারের সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং গত গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০২ শতাংশ বেড়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সুদহার বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সুদ পরিশোধ বেড়েছে বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা ।
তারা জানান, যুদ্ধ পরিস্থিতে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর)— স্বল্পমেয়াদি সুদহারের বেঞ্চমার্ক—বেড়েছে। বর্তমান সোফর রেট ৫ শতাংশের এর বেশি, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১ শতাংশের কম ছিল।
অন্যাদিকে বাংলাদেশের বাজারভিত্তিক ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশকে এখন সুদ বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে যে ঋণ পায়, তার প্রায় ৭৫ শতাংশ বাজারভিত্তিক ঋণ। এছাড়া এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ও বিশ্বব্যাংক থেকেও স্বল্প পরিসরে বাজারভিত্তিক ঋণ নেয় বাংলাদেশ।
এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও বাজেট সহায়তা বাবদ সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়ার কারণেও সুদ পরিশোধের চাপ বাড়ছে বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা।
এদিকে সুদহার বৃদ্ধির সঙ্গে সরকারের মোট ঋণ পরিশোধের হারও বেড়েছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-এপ্রিল সময়ে সরকারের ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। সরকার সুদ ও আসল মিলিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের এ সময় মোট পরিশোধ করেছে ২.৮১ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১.৯৫ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে আসল ও সুদ মিলিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়ে ৩.৫৬ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তবে সস্তা ঋণের পরিমাণ কমছে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'বাজারভিত্তিক ঋণ ও দ্বিপাক্ষিক ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। এসব ঋণের সুদহার বেশি, আবার পরিশোধের সময়ও কম থাকে। আবার আমাদের অনেক মেগা প্রকল্পের জন্য নেওয়ার ঋণের গ্রেস প্রিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে আসল পরিশোধের চাপও বেড়েছে। এবং আগামীতে এই চাপ আরও বাড়তে থাকবে।'
তিনি বলেন, 'এই অবস্থায় আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ পরিশোধে সতর্ক থাকতে হবে। যদিও আমরা এখনও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি। ভালো প্রকল্প বছাই করার পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বাড়াতে হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশাও বলেন, রাজস্ব আহরণ বাড়ানো গেলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ কমানো সম্ভব।
'তবে রাজস্ব রাজস্ব আহরণ বাড়াতে সরকার সংস্কার বাস্তবায়ন করছে না। এখনও অনেক ধনী যথাযথভাবে আয়কর দিচ্ছে না। জেলায় জেলায় ধনীর পরিমাণ বেড়েছে,' বলেন তিনি।
ঋণ প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৩৭ শতাংশ
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ৭.৬ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে—যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেশি।
কর্মকর্তারা জানান, এবার ঋণ গ্রহণের জন্য যেসব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিতে যেতে হয়, সে প্রস্তুতি ভালো ছিল। এ কারণে অর্থবছরের শুরু থেকে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অনেক প্রকল্পের ঋণচুক্তি করা সম্ভব হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে প্রস্তুতির অভাবে শুরুর দিকে অনেক প্রকল্পের ঋণচুক্তি করা যায়নি।
চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে ১০.১৯৪ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে ইআরডির।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে এডিবির কাছ থেকে। এ সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া গেছে ২.৬৯ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি। এছাড়া জাপানের কাছ থেকে ২.০৩ বিলিয়ন ডলার ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ১.৪১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
অর্থবছাড় বেড়েছে ৬ শতাংশ
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় হয়েছে ৬.২৮ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থছাড়ের পরিমাণ ছিল ৫.৯১ বিলিয়ন ডলার।
এই সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে জাপান, ১.৬৬ বিলিয়ন ডলার। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থছাড় করেছে এডিবি, ১.৪৯ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ১.০৫ বিলিয়ন ডলার। আর রাশিয়া ৮৫৭.৮ মিলিয়ন ডলার ও চীন ৩৬১.৭১ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে।