আগামী অর্থবছর থেকে করের আওতায় আসতে পারে আইটি খাতের ২৭টি সেবা
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ২৭ ধরনের সেবার ওপর দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে আসা কর অব্যাহতি আগামী বাজেট থেকে প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর ফলে আগামী অর্থবছর থেকে আইটি খাতের ওইসব সেবার আয়ের ওপর কর আরোপ হতে পারে।
আইটি-সংক্রান্ত শীর্ষ সংস্থাগুলো অর্থমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হলে এ খাতের প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ ও রপ্তানি কমে যেতে পারে।
বাজেট পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, ২০১১ সাল থেকে আইটি সেবার ওপর কর অব্যাহতি দিয়ে আসছে এনবিআর। তিন থেকে পাঁচ বছর করে এই কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। তবে আগামী ৩০ জুন এই অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর না বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হলে এ-সংক্রান্ত কোম্পানিগুলোর আয়ের ওপর কর্পোরেটর কর হিসেবে ২৭.৫ শতাংশ কর আরোপ হওয়ার কথা।
তবে এনবিআর সূত্র জানায়, শুরুতে অল্প পরিমাণ কর ধার্য করা হতে পারে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি বাড়তে পারে।
তবে কী পরিমাণ কর ধার্য করা হবে, কিংবা অব্যাহতি তুলে দেওয়ার পর এ খাতের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা বিশ্লেষণ করছে কর বিভাগ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের আয়কর বিভাগের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চলতি বছর কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। কিছু খাতে কর অব্যাহতি কমানোর পরিকল্পনা আছে। এই সেবা খাতের কর অব্যাহতিও বাতিলের পরিকল্পনা রয়েছে।'
আগামী জুনে অর্থমন্ত্রী পরবর্তী বছরের বাজেট সংসদে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে।
কর অব্যাহতি ছাড়াও ভ্যাটের ক্ষেত্রেও হ্রাসকৃত ভ্যাট দেওয়ার সুবিধা পাচ্ছে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে ভ্যাটের হার হার ১৫ শতাংশ হলেও এ খাতের ওপর বর্তমানে ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। অবশ্য ভ্যাটের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পরিবর্তনের বিষয়ে জানা যায়নি।
অবশ্য আইটি সেবা খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এই সুবিধা না বাড়ানো হলে এ খাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত ১০ মার্চ বেসিসসহ পাঁচ সংগঠনের নেতারা অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে চিঠি দিয়ে কর অব্যাহতি সুবিধা ২০৩১ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।
শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতে বছরে স্থানীয় বাজারের আকার প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার। আর রপ্তন্নির পরিমাণ ১.৯ বিলিয়ন ডলার। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৭২ মিলিয়ন ডলার নতুন বিনিয়োগ এসেছে।
অ্যাসোসিয়েট সদস্যসহ বেসিসের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ৪০০-র বেশি। সংগঠনটির সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩ লাখসহ দেশে এ খাতে মোট কর্মসংস্থানের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।
এর আগে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়েছিল। ওই বছর নতুন করে চার বছরের জন্য তা বাড়ানো হয়, যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ জুন।
বর্তমানে কর অব্যাহতি সুবিধা পাওয়ার আওতায় রয়েছে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন কাস্টমাইজেশন, নাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), ডিজিটাল অ্যানিমেশন ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট সার্ভিস, ওয়েব লিস্তিং, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, ওয়েবসাইট হোস্টিং, ডিজিটাল গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রি অ্যান্ড প্রসেসিং, ডিজিটাল ডেটা অ্যানালিটিক্স, গ্রাফিক্স ইনফরমেশন সার্ভিস (জিআইএস), আইটি সাপোর্ট অ্যান্ড সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সার্ভিস, কল সেন্টার সার্ভিস, ওভারসিজ মেডিক্যাল ট্রান্সক্রিপশন, সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশান সার্ভিস, ডকুমেন্ট কনভারশন, ইমেজিং অ্যান্ড ডিজিটাল আর্কাইভিং, রোবোটিক প্রসেস আউটসোর্সিং, সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস, ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস এবং আইটি ফ্রিল্যান্সিং।
বেসিসের সেক্রেটারি হাশিম আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'আমরাও শুনেছি আগামী বছর কর অব্যাহতি সুবিধা হয়তো আর বাড়ানো হবে না। তবে কত হারে কর ধরা হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।'
বেসিসের সাবেক প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবির টিবিএসকে বলেন, 'কর অব্যাহতি তুলে দেওয়া হলে এই শিল্পে খুবই খারাপ ইমপ্যাক্ট তৈরি হবে, বিশাল সেটব্যাক হবে। আমাদের শিল্পের সামনে লক্ষ্য রয়েছে রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার। এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে ওই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা তো সম্ভব হবেই না, বরং খরচ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারেও লোকাল সফটওয়্যার সাপ্লাই সংকুচিত হতে পারে এবং এতে বিদেশি সফটওয়্যারনির্ভরতা বাড়তে পারে।'
তিনি বলেন, 'এই সুবিধা অন্তত ২০৩১ সাল পর্যন্ত দেওয়া উচিত। এর পর থেকে হয়তো সামান্য করে কর আরোপ করা যেতে পারে।'
বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, কর অব্যাহতি তুলে দিলে এ খাতের অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে।
সাবেক এনবিআর সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, কর অব্যাহতি তুলে দিয়ে একবারেই পুরো কর আরোপ করা যৌক্তিক হবে না। তাতে এ খাতের অগ্রগতি ও রপ্তানি ব্যাহত হতে পারে।
টিবিএসকে তিনি বলেন, 'যদি এ খাতের ওপর থেকে কর অব্যাহতি তুলে দিতেই হয়, তাহলে খুব সামান্য পরিমাণে কর আরোপ করার মাধ্যমে শুরু করা যেতে পারে।'