জ্বালানি, ডলার সংকটে থাকা ব্যবসায়ীরা এক্সিট পলিসি চান
চলমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধি, ডলারের দরবৃদ্ধিতে ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। এ পরিস্থিতিতে তারা এক্সিট পলিসি চেয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) রাজধানীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক কমিটির সভায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, 'ডলার সংকট, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে ব্যবসা এখন নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য এক্সিট পলিসি দিন।'
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, 'দিনশেষে আমরা ডলার দেশে আনার ব্যবস্থা করি। কিন্তু আমরা যদি এত প্রতিবন্ধকতার জন্য ব্যবসা করতে না পারি, তাহলে সরকারের ডলার আসবে কোত্থেকে?'
রাজধানীর একটি হোটেলে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এবং এনবিআরের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত সভায় সভায় অন্যান্য ব্যবসায়ী নেতারাও একই সংকটের কথা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম রপ্তানি খাতের সংকট তুলে ধরে বলেন, 'সুদহার বাড়ছে, ডলার রেট বাড়ছে। ব্যাংক আমাদের সাথে ব্যবসা না করে ডলার ব্যবসায় নেমেছে।
'রপ্তানি পণ্যের দর পাচ্ছি না। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দরে অর্ডার নিতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় এবার বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, আমাদের জন্য সেফ এক্সিট পলিসি দরকার।'
তিনি বলেন, 'ব্যাংকগুলোর জন্য সরকার সহজ এক্সিট পলিসি করেছে। কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে গ্রাহক সর্বোচ্চ মাত্র ১ লাখ টাকা পাবে। অথচ শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য কোনো সহজ এক্সিট পলিসি নেই।'
ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তা মাসুদুল আলম মাসুদ বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। গ্যাসের দাম বেড়েছে দফায় দফায়। গ্যাসের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে দেশে বিনিয়োগ আসবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মুনির হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'এক্সিট পলিসি হচ্ছে লোকসান, প্রাকৃতিক কারণে বা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধে অক্ষম কোনো ব্যবসাকে সুযোগ দেওয়া।'
তিনি বলেন, এক্সিট পলিসি মানে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সুযোগ দেওয়া নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো এক্সিট পলিসি নেই।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীমের সভাপতিত্বে সভায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী উপস্থিত ছিলেন।
সভায় অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের বক্তব্য বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, 'সবার সুচিন্তিত মতামত বিবেচনা করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সবার ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করতে চান।'
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট
আলোচনায় উত্তরা মোটর্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মতিউর রহমান দেশের সব শিল্পই গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য ভোগান্তি পোহাচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য সবার খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
'অর্থমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনি আমাদের গ্যাস দেন। রেভিনিউ যা চান, আমরা দিতে রাজি আছি। গ্যাস-বিদ্যুৎ দিয়ে আমাদের কারখানা চালানোর ব্যবস্থা করেন। এলপিজি দিয়ে এই কারখানা চালানো আর সম্ভব নয়,' বলেন তিনি।
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. খোরশেদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় আমার একটি কারখানায় গত দুই দিন ধরে উৎপাদন প্রায় বন্ধ গ্যাসের অভাবে। একই এলাকার গ্যাসনির্ভর সব কারখানার অবস্থা প্রায় একই।'
কর ব্যবস্থায় হয়রানি দূর করার দাবি
সভায় কর ব্যবস্থায় হয়রানি ও জটিলতা দূর করার মাধ্যমে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বলেন, হয়রানি ও জটিলতা দূরীকরণের মাধ্যমে ব্যবসাবান্ধব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আগামী বাজেটে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানাই।
বিশেষত ব্যবসার খরচ কমিয়ে আনতে বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুষম বিনিয়োগসহায়ক মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সব ধরএন্র পরিবহন খরচ কমানো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ প্রতি ক্ষেত্রে স্থায়ী পরিকাঠামো উন্নয়ন, স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার দাবিও জানান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের সভাপতি।
তিনি বলেন, 'আমরা ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ চাই যাতে ব্যবসা করা সহজ ও সাশ্রয়ী হয়।'
বিকেএমইএর মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিপন্থী।
এ সময় তিনি বেশ কিছু উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, 'অস্বাভাবিকভাবে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে, যা এখন অসহনীয় হয়ে গেছে। এর মূল কারণ কর্মকর্তাদের প্রণোদনা। এর কারণে তারা অন্যায়ভাবে রপ্তানি আটকে রেখে জরিমানা আদায় করেন।'
সভায় গত কয়েক বছরে ব্যবসার স্বার্থে এনবিআরের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপও তুলে ধরা হয়।
বিটিএমএর খোকন বলেন, যারা ব্যাংক থেকে চুরি করেছে, তাদের ঋণকে মন্দ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত না করে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
লুটেরাদের বহিষ্কার করতে এবং সৎ ব্যবসায়ীদের সাথে তাদের তহবিল মিশ্রিত না করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
খোকন আর বলেন, 'আমরা আমাদের ঋণ এবং কর বিশ্বস্ততার সঙ্গে পরিশোধ করেছি। গ্যাসের ঘাটতি বা মুদ্রার ওঠানামার কারণে যদি আমাদের শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়, তাহলে আমাদের ব্যবসা বন্ধ করার একটি এক্সিট স্ট্র্যাটেজি প্রয়োজন।'