সুদহারে ‘স্প্রেড’ ৪.৬৬ শতাংশ, ব্যাংকগুলো বেশি মুনাফা করছে
ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের যে হারে সুদ দিচ্ছে, ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ নিচ্ছে তারচেয়েও বেশি হারে। ফলে আমানত ও ঋণের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে স্প্রেড—আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান—বেড়ে ৪.৬৬ শতাংশ হয়েছে। সেপ্টেম্বরে স্প্রেড ছিল ৩.৩১ শতাংশ। এর অর্থ, ব্যাংকগুলোর মুনাফা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের গড় ঋণের সুদহার ছিল ৯.৩৬ শতাংশ। কিন্তু এক বছর আগেও ব্যাংকঋণের গড় সুদের হার ছিল ৭.২২ শতাংশ। এক বছরে সুদহারের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯.৬৪ শতাংশ। অন্যদিকে আমানতের সুদহার বৃদ্ধির হার ছিল ১১.১১ শতাংশ। কারণ এক বছরের মধ্যে ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার ৪.২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪.৭০ শতাংশে পৌঁছেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির আওতায় সব ধরনের আমানত ও ঋণের সুদহার বাড়ছে। কিন্তু ঋণের সুদের তুলানায় আমানতের সুদ বাড়ছে কম। এতে চড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে আমানতকারীরা মুনাফা কম পেয়ে ও ঋণগ্রহীতারা বেশি সুদ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এদিকে সুদহার বাড়লেও মূল্যস্ফীতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে জানান তারা। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ৯ শতাংশ ঋণ বিতরণের সীমা তুলে দেওয়ার পর থেকে ঋণের সুদহার বাড়ছে। তবে যে গতিতে ঋণের সুদহার বাড়ছে সে অনুযায়ী আমানতের সুদহার বৃদ্ধির গতি কম। তাই আমানত ও ঋণের মধ্যকার সুদহারের পাথর্ক্যও (স্প্রেড) বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য সবসময় কৌশলী হয়। কারণ ঋণের সুদহার যত দ্রুত বাড়বে, মুনাফাও তত দ্রুত বাড়বে।
'আমানতকারীদের যদি এক মাসও অপেক্ষা করানো যায়, তাহলে তার লাভের অংশ ব্যাংকের খাতায় যুক্ত হবে। আমানতের সুদহার ধীরগতিতে বাড়ানোর ফলে সাধারণ আমানতকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন,' বলেন তিনি।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান টিবিএসকে বলেন, সাধারণত ব্যাংকের ঋণের সুদহারই সবসময় আগে বাড়ে। এরপর আমানতের সুদহার বাড়ে। কারণ প্রতিযোগিতার বাজারে যে যত কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফা করতে পারবে, সে-ই লাভবান।
'এতে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্য ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হলে চাহিদা ও সরবরাহ বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়,' বলেন তিনি।
গত দুই বছর ধরে দেশে চড়া মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। এতে গত অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ঋণের সুদহার ব্যাপকভাবে বাড়ানো শুরু হয়েছে। আমানতের সুদহার বাড়তে শুরু করেছে গত অক্টোবর থেকে। ওই সময়ে ঋণের সুদহার যেভাবে বেড়েছে, ওই গতিতে আমানতের সুদহার বাড়েনি।
গত জুলাই থেকে ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণের জন্য করিডোর আরোপ করেছে। এতে ঋণের সুদহার বাড়ানোর পদ্ধতি থাকলেও ব্যাংকের আমানতের সুদহার সমন্বয়ের কোনো পদ্ধতি নেই। ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদামতো আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে। এতে আমানতের সুদহার বেড়েছে অনেক কম।
সাম্প্রতিক সমন্বয়ের পরও মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে আমানতের গড় সুদহার অনেক নিচে রয়েছে। গত ডিসেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৪১ শতাংশ। ওই সময়ে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৪.৭০ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হারের প্রায় অর্ধেক ছিল আমানতের সুদহার।
ফলে ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন টাকার ক্ষয় বেশি হচ্ছে। এতেও গ্রাহকরা ব্যাংকে আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। সে কারণে আমানত প্রবৃদ্ধির হার খুবই কম।
যদিও ব্যাংকগুলোকে দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের নভেম্বরে সুদহারের স্প্রেড ৪ শতাংশের মধ্যে রাখার সীমাবদ্ধতা উঠিয়ে দিয়েছে। কারণ ঋণের সুদহার স্মার্ট রেটের (সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অভ ট্রেজারি বিল) সঙ্গে যুক্ত থাকে।
স্প্রেড সীমা তুলে না দিলে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কারণ স্প্রেড সীমাবদ্ধতা থাকলে যেসব ব্যাংক কম সুদে আমানত নিতে পারবে, তারা চাইলেও বেশি সুদে বিনিয়োগ করতে পারবে না। সেই চিন্তা করে সুদহারের স্প্রেড ৪ শতাংশের মধ্যে রাখার সীমাবদ্ধতা তুলে দেওয়া হয়েছে।