২০২৪–২৫ অর্থবছরে উচ্চ আয়ের মানুষদের ওপর কর বাড়ানোর পরিকল্পনা এনবিআরের
উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগৃহীত কর-রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোভিডপূর্ববর্তী সময়ের মতো সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ করহারে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জনগণ ও অর্থনীতিকে মহামারির ধাক্কা থেকে কিছুটা স্বস্তি দিতে ২০২০–২১ অর্থবছরে ব্যক্তিগত আয়করের সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজস্ব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এনবিআরের আয়কর বিভাগ আগামী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটের জন্য শীর্ষ প্রান্তিক আয়কর হারে ৫ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে।
বর্তমানে এনবিআর পাঁচটি শ্রেণির অধীনে ব্যক্তিগত আয়কর সংগ্রহ করে।
সাড়ে তিন লাখ টাকার করমুক্ত আয়সীমার পর থেকে করের বিভিন্ন হার শুরু হয়। সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ৫ শতাংশ, সাড়ে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, সাড়ে ১১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, সাড়ে ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ২০ শতাংশ এবং সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ কর সংগ্রহ করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা শীর্ষ শ্রেণির জন্য করহার বাড়ানোর কথা ভাবছি। ২০২০ সালে দেশে করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার পর এটি হ্রাস করা হয়েছিল।' তবে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো হারের কথা জানাননি।
বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, এ পদক্ষেপ কিছু ইতিবাচক ফলাফল আনতে পারে। তবে তারা সতর্ক করে দিয়েছেন, প্রভাবশালী গোষ্ঠী, বিশেষ করে যারা বড় অঙ্কের কর প্রদান করে এবং এনবিআরের নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখার যাদের সক্ষমতা রয়েছে, তারা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে পারে।
মহামারির আগে ২০১৯–২০ অর্থবছরে ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য সর্বোচ্চ কর শ্রেণি ছিল ৩০ শতাংশ, আর সর্বনিম্ন ছিল ১০ শতাংশ।
মহামারির সময় মানুষের আয় কমে যাওয়ায় করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার ২০২০–২১ অর্থবছরে সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ উভয় করশ্রেণিতে ৫ শতাংশ পয়েন্ট হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এনবিআরের আরেক কর্মকর্তা বলেন, 'শীর্ষ আয়কর শ্রেণিকে প্রাক-কোভিড স্তরে ফিরিয়ে আনার জন্য আলোচনা চলছে।'
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই–ফেব্রুয়ারি) আয়কর ও ভ্রমণ কর হিসেবে আদায় হয়েছে ৭২ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। পুরো অর্থবছরে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় এক লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
২০২২–২৩ অর্থবছরে এনবিআর এক লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয়কর এবং ভ্রমণ কর হিসেবে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করেছিল।
আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের শর্ত অনুযায়ী, এনবিআর চলতি অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে অঙ্গীকারবদ্ধ। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর আগে এক প্রক্ষেপণে প্রস্তাব করে, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করতে রাজস্ব বোর্ডকে অতিরিক্ত দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে।
সংস্থাটির হিসেব অনুসারে, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এনবিআরকে কর-রাজস্ব হিসেবে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে চার লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৫–২৬ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে।
এনবিআরের প্রায় ৪০ শতাংশ কর-রাজস্ব আসে ব্যক্তি এবং কর্পোরেট আয়কর থেকে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, যদি আইএমএফের সঙ্গে সম্মত সময়সীমার মধ্যে নীতি সংস্কার করা হয় তাহলে চ্যালেঞ্জিং হলেও এ লক্ষ্য অর্জনযোগ্য।
আশাবাদ ও সতর্কতা উভয়ই
তবে কর-জিডিপি অনুপাতের মতো ব্যক্তিগত আয়ের ওপর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ করের হার বেশিরভাগ দেশের তুলনায় কম। ভারতে এটি ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ৩৫ শতাংশ। সিঙ্গাপুরে সর্বোচ্চ করহার ২২ শতাংশ, যদিও ধনী দেশগুলোতে এ হার সচরাচর অনেক বেশি হয় — যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৭ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৪৫ শতাংশ।
এনবিআরের পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এনবিআরের সাবেক সদস্য ডক্টর সৈয়দ মো. আমিনুল করিম উচ্চ আয়কারীদের জন্য করহার বাড়ানোর এনবিআরের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানান।
এনবিআর ২০১১–১২ অর্থবছরে শীর্ষ করশ্রেণি ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করে। সে সময় কর-নীতির দায়িত্বে ছিলেন আমিনুল করিম।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'করের হার বৃদ্ধি খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে। ট্যাক্স ব্যবস্থা পশ্চাদমুখী না হয়ে প্রগতিশীল হওয়া উচিত। ওপরের শ্রেণিতে হার বাড়ানো হলে যাদের আয় বেশি তাদের বেশি কর দিতে হবে, যা যৌক্তিক।'
ঢাকার একটি কর অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাও এ পদক্ষেপকে যৌক্তিক বলে অভিহিত করেছেন, কারণ এটি নিম্ন আয়ের করদাতা শ্রেণির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
তবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে করের হার আগে থেকেই বেশি। তাই ব্যক্তিগত করদাতাদের ওপর আরও করের বোঝা চাপানো অযৌক্তিক।
'আইএমএফ চায় এনবিআরের করা আদায় বাড়ুক। তবে সেটা উচ্চ শ্রেণিতে বাড়িয়ে নয়, বরং সর্বনিম্ন হার বাড়ানোর পক্ষে,' তিনি বলেন।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহম্মদ আবদুল মজিদও করদাতার সংখ্যা না বাড়িয়ে কেবল বিদ্যমান করদাতার ওপর করের হার বাড়ানোর বিপক্ষে।
তিনি বলেন, 'এনবিআর নতুন করদাতা প্রত্যাশিতহারে বাড়াতে পারছে না। ওই চাপ বিদ্যমান করাদাতার ওপর দিতে চাওয়া অযৌক্তিক। এ সব কারণে মানুষ করের আওতায় আসতে নিরুৎসাহিত হবে।'
বর্তমানে দেশে এক কোটির বেশি ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরধারী (টিআইএন) রয়েছেন। গত বছর তাদের মধ্যে প্রায় ৩৬ লাখ আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন। অবশ্য এর মধ্যে একটি অংশ শূন্য রিটার্ন জমা দিয়েছেন, যার জন্য কোনো কর দিতে হয়নি।
করদাতার আয়ের ওপর চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়াসহ কিছু অনুমোদনযোগ্য খরচ থাকে, যার পরিমাণ সর্বোচ্চ সাড়ে চার লাখ টাকা বা মোট আয়ের এক তৃতীয়াংশের মধ্যে যেটি কম। আবার সরকার অনুমোদিত কিছু বিনিয়োগেও করছাড় পান করদাতা।
৫ শতাংশ বৃদ্ধিতে ১০ হাজার কোটি টাকা সম্ভব?
সাবেক এনবিআর সদস্য আমিনুল করিম বলেন, '২০১২ সালে যখন আমরা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করেছিলাম, তখন হিসেব করে দেখেছি, বাড়তি প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার কর আদায় হবে। আর বর্তমানে এটি অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা হবে।'
সর্বোচ্চ শ্রেণির করদাতা বা যারা ২৫ শতাংশ করহারের অধীন, তাদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যার সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এনবিআর সূত্রমতে ২০২১–২২ অর্থবছরে প্রায় ১৭ লাখ সর্বোচ্চ শ্রেণির করদাতা ছিলেন। তবে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এ ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
মোট আদায়কৃত করের কত অংশ ব্যক্তিগত করদাতাদের কাছ থেকে আসে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্যও জানা যায়নি।
তা সত্ত্বেও এনবিআরের ২০১৯–২০ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদায়কৃত করের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে কোম্পানিবহির্ভূত খাত থেকে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত করদাতা ছাড়াও ফার্ম ও অন্যান্য খাত রয়েছে।
ক্ষমতার প্রভাব
সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কাছ থেকে এনবিআরের এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ আসতে পারে — বিশেষ করে যারা বড় অঙ্কের কর প্রদান করে এবং এনবিআরের নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখার যাদের সক্ষমতা রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠ পর্যায়ের একটি কর অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এনবিআরের উদ্যোগটি শেষ পর্যন্ত বাজেট প্রস্তাব হিসেবে বাস্তবায়িত হবে কি না বা এটি শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী মহলের প্রতিরোধের মুখোমুখি হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
এনবিআরের সাবেক সদস্য সৈয়দ মো. আমিনুল করিমও এ মহল থেকে সম্ভাব্য চাপের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।