মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের জন্য পোশাক বানিয়ে ভাগ্যোন্নয়নের পথ দেখাচ্ছে বগুড়া
বগুড়ায় বিকশিত হচ্ছে এক অনন্য শিল্প। মধ্যপ্রাচ্যের রাজা ও শাসকদের পরিধেয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক 'বেস্ত' উৎপাদন হচ্ছে এ জেলায়। কর্মী ও উদ্যোক্তাদের সামনে নানা লাভজনক সুযোগ তৈরি করে জীবন বদলে দিচ্ছে এই অনন্য খাত।
এই অনন্য রূপান্তরের উদাহরণ শরিফুল ইসলাম। গাড়ি ওয়াশের কাজ ছেড়ে তিনি এখন মধ্যপ্রাচ্যের স্বনামধন্য রাজা-বাদশাহদের পোশাক বেস্ত তৈরি করেন। সাত বছর ধরে বগুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক কারখানায় এ কাজের সঙ্গে যুক্ত শফিকুল জানালেন, এখানে কাজ শিখে তার অনেক সহকর্মী সৌদি আরব বা কাতারে গিয়ে ঐতিহ্যবাহী পোশাক তৈরি করছেন। আগের কাজে শফিকুল যে আয় করতেন, এখন আয় করছেন তারচেয়ে অনেক বেশি। শফিকুলের মতো আরও অনেকেই এ কাজ থেকে শেখা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আরও বেশি বেতনে কাজ করছেন।
এ প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পকে এগিয়ে নিচ্ছে, এমন তিনটি বেস্ত কারখানা 'প্রবাসী' তিন ভাইয়ের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বগুড়া সদরের হাপুনিয়া এলাকায়। কারখানাগুলো এখন প্রশিক্ষণ একাডেমির মতো। এখানে অনেকে কাজ শিখে ভাগ্যোন্নয়নের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাচ্ছেন। কেউ বা যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
শরিফুল কাজ করেন স্থানীয় প্রবাসী নুর আলমের কারখানায়। শরিফুল জানান, একসময় তিনি গাড়ি ওয়াশের কাজ করতেন। পরে এই কারখানার খোঁজ পান। যোগাযোগ করেন মালিকের সাথে। গাড়ি ওয়াশের কাজ ছেড়ে শুরু করেন বেস্ত তৈরি। এরপর বদলে যায় তার জীবনের গল্প। প্রথমে ৮ হাজার টাকা পেলেও এখন প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় করেন শরিফুল।
বেস্ত তৈরির কারিগর বা শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক চাহিদার কথা জানালেন বগুড়ায় রায়হান আলী। একসময় তিনি সৌদি আরবে ছিলেন। সেখানে তিনিও বেস্ত তৈরি করতেন। অবশ্য এখন তিনি বগুড়ার সদর উপজেলার বানদীঘি হাপুনিয়াপাড়ার পাশের কবুরহাটে 'মমতাজ মহল' নামে বেস্ত তৈরির কারখানা গড়েছেন। ২০১২ সালের দিকে রায়হান কারখানার কাজ শুরু করেন চারজন শ্রমিক নিয়ে। এখন সেখানে অন্তত ৮০ জন শ্রমিক কাজ করেন।
রায়হান বলেন, গড়ে প্রতি মাসে তার কারখানায় অন্তত ২০০ পিস বেস্ত তৈরি করা হয়। এগুলো পাইকারি পাঠানো হয় সৌদি আরব, কাতার কিংবা কুয়েতে। গড়ে প্রতি মাসে অন্তত ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টাকার পোশাক রপ্তানি করা হয়। তবে বেস্তের চাহিদা এরচেয়েও অনেক বেশি
'মাসে ১০ হাজার পিস পাঠালেও কোনো সমস্যা নেই। আমার কারখানায় এই কাজের চাহিদা এমন যে গোটা উত্তরবঙ্গের মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব, শুধু বেস্ত শ্রমিক হিসেবেই,' বলেন তিনি।
রায়হান জানান, গত ১০ বছরে তার কারখানা থেকে অন্তত ১৫ জন শ্রমিক কাজ শিখে মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন। বাংলাদেশে এই পোশাক তৈরির আর কোনো কারখানা নেই। এমনকি কোনো প্রশিক্ষণ অ্যাকাডেমিও নেই। সেই অর্থে বগুড়ার কারখানা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ অ্যাকাডেমির মতো কাজ করছে।
রায়হানের সাফল্য দেখে তারও আরও দুই ভাই এলাকায় বেস্ত কারখানা গড়েছেন। তৈরি করছেন ঐতিহ্যবাহী এ পোশাক।
বেস্ত তৈরির কাজ বেশ সময়সাপেক্ষ এবং জটিল। এ পোশাক তৈরি করতে একজন শ্রমিকের অন্তত সাত দিন সময় লাগে। কাজ করতে হয় নানা ধাপে। প্রথমে কাপড় কেটে নিয়ে সেখানে নকশার কাজ শুরু করতে হয়। নকশার প্রথম ধাপকে বলা হয় হেলা। এরপর করা হয় তুক্ত স্রিপ। ব্রুজ, মাকসার, বরদাক—এরপর সিলালার মাধ্যমে শেষ হয় এর ধাপগুলো। ধাপগুলো শেষ হলেই পূর্ণতা পায় বেস্ত।
বেস্ত তৈরির শিল্প নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রতিশ্রুতিশীল জীবিকার পথ সুগম করছে। আবদুল্লাহ আল মুরাদের মতো শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য খণ্ডকালীন কাজ করেন। আবার রিহাদ হোসেনের মতো অন্যরা এই পেশাকে প্রথাগগত অফিসের চাকরির চেয়ে বেস্ত তৈরির কাজে বেশি সম্ভাবনাময় মনে করেন।
তসলিমা বেগমের মতো নারীরা এই শিল্পকে আরও শক্তিশালী করছেন। নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়নের সুযোগ করে দিচ্ছে শিল্পটি। বেস্ত কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিক প্রায় ৪০ শতাংশ।
নূর আলমের করখানায় কাজ করা তাসলিমা জানান, 'এই কাজের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, বাড়ির কাজের পাশাপাশি করা যায়। আর এখান থেকে যে আয় হয় সেটা দিয়ে গ্রামের একটি সংসার ভালোভাবে চালানো সম্ভব।'
দারুণ সম্ভাবনাময় এই ব্যবসার কিছু সংকটও রয়েছে। এই শিল্প ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর। বিশেষ করে বেস্তের কাপড় থেকে সুই-সুতা সবই আমদানিনির্ভর। তবে বেশি সংকটে পড়তে হয় কাপড় নিয়ে। বেস্ত তৈরির কাপড় বিশ্বে জাপান ছাড়া আর কোথাও তৈরি হয় না। কাতার হয়ে এই কাপড় জাপান থেকে আমদানি করতে হয়। এতে অপ্রয়োজনীয় জটিলতা বাড়ে। এই সংকট সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন রায়হান আলী।
বগুড়ায় তৈরি বেস্তের ব্যাপক চাহিদার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বগুড়া কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, 'বগুড়ায় ক্রমাগত এই পোশাক তৈরির কারখানা বড় হচ্ছে। আগে একটি কারখানা ছিল। এখন তিনটি। তিন কারখানায় অন্তত ২০০ জন শ্রমিক কাজ করেন। উদ্যোক্তা তৈরিতে ঋণ কিংবা প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত বিসিক। আমরা নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছি। '