অস্থিতিশীল পুঁজিবাজারে সরবরাহের জন্য আইসিবি কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা পেতে যাচ্ছে
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মূলত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে থাকে। পুঁজিবাজারের কার্যক্রম বাড়ানো এবং উচ্চ-সুদের কিছু মেয়াদি আমানত পরিশোধ করার লক্ষ্যে সংস্থাটি সরকারের কাছ থেকে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত তহবিল পেতে যাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে অবগত থাকা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), অর্থ মন্ত্রণালয়, এবং আইসিবি-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণ-নিশ্চয়তার (সভরেইন গ্যারান্টি) সাপেক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগ ব্যাংকটিকে এ তহবিল সরবরাহ করবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন, শেয়ারবাজারের অন্যতম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী আইসিবি'র পুঁজিবাজারের কার্যক্রমকে সমর্থনে সরকারের তৎপরতার অংশ হিসেব সরকারি সুপারিশের সাথে সঙ্গতি রেখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আইসিবি'র চেয়ারম্যান সুবর্ণ বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পুঁজিবাজারের জন্য সরকারের কাছ থেকে তহবিল সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে আমরা খুবই ইতিবাচক ও আশাবাদী। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইসিবিকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব জমা দিতে বলেছে এবং আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি।
'যেহেতু আইসিবি'র প্রধান ম্যান্ডেট হলো শেয়ারবাজারে সমর্থন দেওয়া, তাই তহবিলের একটি অংশ পুঁজিবাজারে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া বাজারকে সহায়তা দিতে কয়েক বছর ধরে আইসিবি'র নেওয়া উচ্চ-সুদের মেয়াদি আমানত পরিশোধ করতেও তহবিলের কিছু অংশ ব্যবহার করা হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের একজন অধ্যাপক সুবর্ণ বড়ুয়া বলেন, সরকারি এ তহবিল সহায়তা প্রত্যাশিত। আইসিবি'র বিনিয়োগ সক্ষমতা শক্তিশালী করার পাশাপাশি এ তহবিল বাজারকে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করবে। 'তাই এটি আমাদের এবং শেয়ার বাজারের জন্য খুব ইতিবাচক হবে,' তিনি আরও বলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসি'র একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, তারা তহবিল সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গেও কথা বলেছেন। 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক তহবিল দিতে রাজি হয়েছে। তহবিল ছাড় হলে আইসিবি'র বিনিয়োগ সক্ষমতা জোরদার হবে এবং সামগ্রিক বাজার উপকৃত হবে,' তিনি আরও বলেন।
ক্রমবর্ধমান সুদহারের মধ্যে তারল্য সংকটের কারণে দেশের শেয়ারবাজার একটি অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুই স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক এবং টার্নওভারে উল্লেখযোগ্য পতন ঘটেছে।
অস্থিতিশীল বাজারে মুনাফা কমছে আইসিবি'র
বিনিয়োগকারীরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পুঁজিক্ষয় হতে দেখেছেন। ২০২২ সালের জুলাই মাসে ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালুর প্রায় দুই বছর পর জানুয়ারিতে তা অপসারণের পরে বাজার মূলধন প্রায় এক লাখ কোটি টাকা কমে যায়। ফ্লোর প্রাইস হলো কোনো স্টক বেচাকেনার সর্বনিম্ন মূল্য। আর শেয়ার নির্ধারিত ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামতে পারে না।
বাজারের অস্থিরতা রোধের পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিএসইসি ২৪ এপ্রিল তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম দিনে ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না বলে আদেশ দেয়।
অস্থিতিশীল বাজারের কারণে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আইসিবি ২৬৭ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এটির মূলধন লাভ ৫৯ শতাংশ কমে ১০৫ কোটি টাকা হয়েছে। এছাড়া আমানত ও ঋণের সুদ পরিশোধ ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়ে ৬৭৫ কোটি টাকা হয়েছে।
২০২২–২৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ ব্যাংকটির মুনাফা ৪৬ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৭৭ কোটি টাকা হয়। এছাড়া ফ্লোর প্রাইস সীমাবদ্ধতার মধ্যে শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় আইসিবি এটির আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
মেয়াদি আমানত বোঝা
২০২২–২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, সাধারণ জনগণ, ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আইসিবি-এর আট হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা মেয়াদি আমানত রয়েছে।
সুদের হারে সাম্প্রতিক উল্লম্ফন প্রতিষ্ঠানটির ওপর ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
আইসিবি-তে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মেয়াদি আমানত পাঁচ হাজার ৩২২ কোটি টাকা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মেয়াদি আমানত তিন হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন, অগ্রণী ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংকের আইসিবি-তে মেয়াদি আমানত রয়েছে তিন হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেয়াদি আমানতের জন্য বিনিয়োগ ব্যাংকটি সুদ পরিশোধ করেছে ৬৬৩ কোটি টাকা।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও আটকে আছে আইসিবি'র তহবিল
কর্মকর্তাদের মতে, আইসিবি'র প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এর বেশিরভাগই দুর্বল ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কেবল পদ্মা ব্যাংকেই আটকে রয়েছে সংস্থাটির ১৫৪ কোটি টাকা।
আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হলেও আইসিবি এসব তহবিল ফেরত পায়নি। অর্থ পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য চেয়েছিল এটি। কিন্তু নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত ফেরত দিতে পারেনি। ফলে বেশিরভাগ তহবিলের মেয়াদ নবায়ন করতে হয়েছে।