আগামী বাজেটের মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
এজন্য বাজেটের আকার তুলনামূলকভাবে ছোট রেখে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক লেনদেনে স্থিতিশীলতা আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগ উৎসাহিত করার পদক্ষেপ থাকবে আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের প্রথম বাজেটে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এমনই ধারণা দিয়েছে অর্থ বিভাগ। সোমবার (১৩ মে) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে কোন কোন ধরনের উদ্যোগ থাকছে, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেছে অর্থ বিভাগ।
সভায় উপস্থিত ছিলেন, অর্থ বিভাগের এমন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বাজেটের পরিকল্পনা জেনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সভায় উপস্থিত থাকা ওই কর্মকর্তা জানান, 'প্রধানমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এবং নির্বাচনী ইশতেহারে করা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়েছেন কর্মকর্তাদের।'
সভায় অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মঙ্গলবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোন খাত থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে, তা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করবে।
গত দুই অর্থবছরের বাজেটেও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে এতে বিশেষ সফলতা আসেনি বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যার কারণে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরেনি।
অর্থ বিভাগের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আগামী বাজেটের মূল লক্ষ থাকবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। এজন্য বাজেটের আকার অন্যান্য বছরের মতো বাড়বে না। বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের কম থাকবে। উন্নয়ন ব্যয়ও কম হবে। তবে পরিচালন বাজেট কমবে না।
সূত্রমতে, আগামী অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করার পরিকল্পনা নিয়েছে অর্থবিভাগ। এরমধ্যে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় এবং ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য থাকবে। ২০২৫ সালের জুন শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে অর্থবিভাগ।
এই বাজেট বাস্তবায়নে এনবিআরের মাধ্যমে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। নন-ট্যাক্স রেভিনিউ হিসেবে সরকার ৭০ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার আশা করছে। আর বাজেটে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই ঘাটতি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে মেটানো হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০.২২ শতাংশে উঠেছে।
অর্থবিভাগ সূত্র জানিয়েছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার উৎপাদন বাড়ানোতে বেশি মনোযোগ দেবে। পাশাপাশি বাজারে সরবরাহ বাড়ানো, বাজারের নন-ইকোনোমিক ফ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ থাকবে।
এছাড়া টাকার প্রবাহ কমানো, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ ও সুবিধাভোগী বাড়ানো, এবং বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
অর্থবিভাগের আরেকজন কর্মকর্তা জানান, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগী প্রায় ৫ লাখ বাড়ানো হবে। বিশেষ করে বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগী দুই লাখ এবং বিধবা, দুস্থ ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী সুবিধাভোগী দুই লাখ বাড়ানো হবে।
এছাড়া মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির ভাতা ২০০ টাকা, ৮০ বছরের বেশি বয়স্ক নাগরিকদের জন্য বয়স্ক ভাতা ৩০০ টাকা বাড়ানো হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় তাদের খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির জন্য ৩৫০ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ পাচ্ছে। এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পরিচালিত হয়, সেখানেও সরকার বাড়তি বরাদ্দ রাখছে।
এদিকে গত ৬ মে বিবিএস ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, দেশে মোট বেকার বেড়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেকার লোকের সংখ্যা ২৫.৯০ লাখ।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বেকারত্ব কমাতে বাজেটে বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ থাকবে। এজন্য শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি খরচ কমানোর উদ্যোগ থাকবে। শ্রমঘন শিল্পে প্রণোদনা থাকবে।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানোর জন্য যেসব উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান সম্পৃক্ত, সেইসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেবে সরকার। পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে উদ্যোগ থাকবে। এছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে এলেও বিদুতে ভর্তুকি থাকছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেওয়া হবে বিদ্যুৎ খাতে---যার পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এরপর রয়েছে কৃষি খাত। এ খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব করা হচ্ছে।
রপ্তানি প্রণোদনায় দেওয়া হবে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। আমদানিকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) খাতে ভর্তুকি দিতে হবে ৭ হাজার কোটি টাকা। খাদ্য খাতে ভর্তুকি থাকবে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর রেমিট্যান্স প্রণোদনায় ভর্তুকির প্রয়োজন হবে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা।