মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় খাদ্যপণ্যে কর না বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, কর্পোরেট কর আরো হ্রাসের পরিকল্পনা এনবিআরের
দেশের বিদ্যমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে খাদ্য, কৃষি সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সারের ওপর কর না বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া, ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনের শর্ত রেখে – পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত নয় এমন কোম্পানিগুলোর জন্য কর্পোরেট করের হার ২.৫ শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণের কথাও ভাবছে রাজস্ব বোর্ড।
গতকাল মঙ্গলবার (১৪ মে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য আট লাখ কোটি টাকার বাজেটে অনুমোদন দেন। তবে নতুন এ বাজেটে দেশের কয়েক কোটি মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের জন্য দুঃসংবাদ থাকতে পারে, কারণ টক টাইম ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক আরো বাড়ানোর কথাও ভাবছে এনবিআর, যা ইতোমধ্যেই বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। এতে সেবাগুলোর জন্য গ্রাহকের খরচও বাড়বে।
বাজেটে সংসদ সদস্যদের জন্য শুল্ক-মুক্ত গাড়ি আমদানি সুবিধা প্রত্যাহার করা হতে পারে। এক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে সাধারণ আমদানিকারকদের ৮০০ শতাংশ পর্যন্ত এ শুল্ক দিতে হচ্ছে।
এনবিআরের সূত্রগুলো জানায়, সংস্থাটির রাজস্ব নীতি কর্মকর্তারা গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে প্রস্তাবিত নীতি পরিবর্তনগুলোর বিষয়ে তাঁকে অবহিত করেন। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ৪০ লাখ টাকার বেশি মূলধনী আয়ের ওপর কর অব্যাহতি থাকলেও– নতুন বাজেটে এটিকে করের আওতায় আনা হতে পারে।
বর্তমানে পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলো ২০ শতাংশ হারে কর্পোরেট কর প্রদানের সুবিধা পাচ্ছে। অন্যদিকে অনিবন্ধিত কোম্পানিগুলোকে ২৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত হারে কর দিতে হয়। তবে নির্দিষ্ট একটি পর্যায়ে পৌঁছানোর পর উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানকেই আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে লেনদেন করতে হয়, অনেক কোম্পানির পক্ষেই যা মেনে চলা সম্ভব হয় না।
নাম না প্রকাশের শর্তে এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আমরা এখন প্রণোদনা-ভিত্তিক করনীতির দিকে ঝুঁকছি। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার উপরে লেনদেন করলে কোম্পানিগুলো কম হারে কর পরিশোধের সুবিধা পাবে। এই প্রস্তাবটি নিয়ে ইতোমধ্যে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথেও আলোচনা করেছি।"
প্রধানমন্ত্রীর সাথে সভায় উপস্থিত সূত্রগুলো জানিয়েছে, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উচ্চ অবস্থানে থাকায় এনবিআরকে খাদ্য বা খাদ্য-সংশ্লিষ্ট আইটেমগুলোর ওপর কোনো কর বা শুল্ক না বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)- এর হালনাগাদ তথ্যানুসারে, গত এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ শতাংশের বেশি।
বর্তমানে কিছু খাদ্যপণ্য, খাদ্যশস্য, সারসহ কৃষি উপকরণ এবং শিল্পের কিছু মৌলিক কাঁচামাল শুল্ক-মুক্ত সুবিধা পাচ্ছে।
টকটাইমে কর বৃদ্ধি
নাম না প্রকাশের শর্তে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, আগামী বাজেটে মোবাইল ফোনের টক টাইম ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর থাকা সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর কথা ভাবছেন তারা। তিনি বলেন, "আমরা আশা করছি, এই প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপিত হবে।"
বর্তমানে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক ও সারচার্জ-সহ মুঠোফোন ব্যবহারকারীর ওপর মোট কর হার হচ্ছে ৩৩ শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ, কেউ যদি ১০০ টাকার টকটাইম রিচার্জ করেন, তাহলে প্রকৃতপক্ষে ৬৭ টাকা সমমূল্যের টকটাইম পান।
এনবিআরের পরিকল্পনাটি গৃহীত হলে, জনসাধারণের মোবাইল ফোনের ব্যয় আরো ৫ টাকা বাড়বে, ফলে টকটাইম কমে হবে ৬২ টাকার। একইভাবে ইন্টারনেট খরচও ৫ টাকা বাড়বে।
অংশীজনরা বলছেন, মুঠোফোনে টকটাইম ও ইন্টারনেট ব্যয় বাড়লে – তা নিম্ন-আয়ের মানুষসহ গ্রাহকদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, "এগুলো লাক্সারি আইটেম নয়। মানুষ নিত্যদিনের প্রয়োজনে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আবারো এর ব্যয় বাড়ানো ঠিক হবে না।"
"বর্তমানে এসব পরিষেবা খুবই উচ্চ করহারের আওতায় আছে। নাগরিকরাও দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মোকাবিলা করছে। তাই কোনোভাবেই পরিষেবাগুলোর ওপর আরো কর বসানো উচিত নয়" - যোগ করেন তিনি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান – পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "টকটাইম ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর সরকার কর বাড়ানো হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ এরমধ্যেই দেশের টেলিকম খাতে বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ করহার রয়েছে।"
"এতে মানুষের ডেটার ব্যবহার কমবে, তাতে সার্বিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে, এবং সরকারের ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরিকল্পনা ব্যাহত হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যয় কমানো উচিত" - যোগ করেন তিনি।
দেশের অন্যতম বৃহৎ মোবাইল পরিষেবাদাতা রবি আজিয়েটা লিমিটেডের প্রধান কর্পোরেট ও রেগুলেটরি কর্মকর্তা সাহেদুল আলম বলেন, করভার বাড়ানো হলে তা এখাতের নেতিবাচক প্রবণতাকে আরো দ্রুত করবে।
"এরমধ্যেই উচ্চ করের চাপ আছে। এরমধ্যে মোবাইল টেলি-যোগাযোগ খাতের বিভিন্ন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক আরেক দফায় বাড়ানো হলে – গ্রাহকদের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একইসঙ্গে তা মোবাইল ইন্টারনেট সেবার সার্বিক ব্যবহার কমাবে। গত কয়েক প্রান্তিক থেকেই মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমছে।"
"সার্বিকভাবে আমরা মনে করছি, কর হার বাড়ানোর উদ্দেশ্য এতে সফল হবে না। কারণ এতে করে, মোবাইল গ্রাহকদের সার্বিক ব্যয়ই কমবে"- তিনি যোগ করেন।
'এনবিআরের জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁস মোবাইল ফোন সেক্টর'
দেশের রাজস্ব কর্তৃপক্ষের জন্য মুঠোফোনের পরিষেবা খাতকে 'সোনার ডিম দেওয়া হাঁস' বলে অভিহিত করেছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।
২০১৫ সালের আগে মুঠোফোনের টকটাইমের ওপর সরাসরি ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক আরো ৩ শতাংশ বাড়ায় এনবিআর। ১ শতাংশ উন্নয়ন সারচার্জসহ পরের পাঁচ বছরে কয়েক ধাপে সম্পূরক শুল্ক আরো ১২ শতাংশ বাড়ানো হয়।
অন্যদিকে, দেশের মুঠোফোন পরিষেবাদাতা কোম্পানিগুলোকে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কর্পোরেট কর দিতে হচ্ছে।
রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, "এনবিআরের নতুন পরিকল্পনা কার্যকর হলে আরো এক হাজার কোটি টাকা আদায়ের সুযোগ তৈরি হবে।"
ড. মনসুর মনে করেন, এমন সিদ্ধান্ত এই খাতের প্রবৃদ্ধি ও বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগকে ব্যাহত করবে।
এনবিআরের সূত্রগুলোর মতে, তামাক খাতের পর দেশের মোবাইল ফোন খাতই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক প্রদান করে। এর সিংহভাগই দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মুঠোফোন খাত থেকে ৯ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করে এনবিআর।
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (বিটিআরসি)'র তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৯ কোটি। গত আট বছরে গড় গ্রাহক প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ৭০ লাখ।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা হচ্ছে ১৩ কোটির বেশি। গত আট বছরে যা বার্ষিক এক কোটি করে বেড়েছে।
বাংলাদেশে টকটাইমের ওপর কর অন্যতম সর্বোচ্চ
শিল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ কর দিতে হয় বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অপারেটর ও গ্রাহকদের।
বর্তমানে টকটাইমের ওপরে বাংলাদেশে মোট কার্যকর করহার হচ্ছে ৩৩.২৫ শতাংশ, যারমধ্যে ১৫ শতাংশ হচ্ছে ভ্যাট, ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১ শতাংশ হচ্ছে সারচার্জ।
প্রতিবেশী ভারতে এই কর ১৮ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৬ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৭ শতাংশ, নাইজেরিয়ায় ৭.৫ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৯ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১১ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানে এটি বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা বেশি বা ৩৪.৫ শতাংশ।