২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর অব্যাহতি কমতে পারে আরো ১৫ হাজার কোটি টাকা
কর ব্যয় হিসেবে পরিচিত কর অব্যাহতি আগামী অর্থবছরের বাজেটে ১৫ হাজার কোটি টাকা কমানো হতে পারে। এতে মোট অব্যাহতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, কর অব্যাহতি হ্রাস করে এবং কর কর্তৃপক্ষের কঠোর তদারকির মাধ্যমে অনিয়মগুলো ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এর শর্তের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকার গত অর্থবছরের বাজেট থেকেই কর অব্যাহতির পরিমাণ প্রকাশ করা শুরু করেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান– কর কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট অব্যাহতির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।
তিনি বলেন, "২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ব্যয় ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩.৫৬ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এটা কমে ২.৯১ শতাংশে নামবে বলে আশা করা হচ্ছে। কর অব্যাহতি কমানোর ফলে এই অর্থ সরকারের রাজস্বে যোগ হবে।"
ওই কর্মকর্তা জানান, আসন্ন বাজেট বক্তৃতায় কর ব্যয়ের প্রাক্কলন প্রকাশ করবেন অর্থমন্ত্রী। একইসঙ্গে কোন কোন খাতে তা কমানো হবে- সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বলা হবে।
অন্যদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন কর্মকর্তা ইঙ্গিত দেন যে, ভৌত অবকাঠামোর মতো কিছু খাতের জন্য এটি কমানো হতে পারে।
তিনি বলেন, "তৈরি পোশাক, ক্ষুদ্রঋণ, রেমিট্যান্স, পোলট্রি, ফিশারি, রপ্তানির নগদ প্রণোদনা এবং আইটি-এনাবলড পরিষেবার মতো খাতেও কর অব্যাহতি হ্রাস করা হতে পারে।"
রাজস্বের এই কর্মকর্তা বলেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কর অব্যাহতি হ্রাস করে জিডিপির ২ শতাংশের নিচে নামানোর লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
'হ্রাসের পরেও কর অব্যাহতির পরিমাণ অনেক বড়'
কর ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর পরিকল্পনা সত্ত্বেও– মোট অব্যাহতি হতে পারে গত অর্থবছরের রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার প্রায় কাছাকাছি, বা প্রায় ১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার মতো।
গবেষণা সংস্থা– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, কর ব্যয় কমিয়ে যদি ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা করাও হয়, তারপরও এটি অনেক বেশি। "এনিয়ে গর্বের কিছু নেই, কারণ এটা হবে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার সমান।"
এই অর্থনীতিবিদের মতে, সরকারের উচিত আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস-সহ কর ব্যয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা। যেখানে কোন কোন খাত কর অব্যাহতি পাচ্ছে, কতোটা পাচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতিতে তাঁদের অবদান কতটুকু তাঁর বিস্তৃত বিবরণ থাকবে।
এ ছাড়া, নির্দিষ্ট একটি সময়সীমার মধ্যে কর অব্যাহতি কমানোর একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে ওই প্রতিবেদনে। এবং অন্যায্য অব্যাহতিগুলোকে পরিহার করতে হবে, আরো বলেন তিনি।
কর অব্যাহতির সুবিধা কারা পাচ্ছে
কর অব্যাহতি বলতে মোট করযোগ্য আয় থেকে– রেয়াত, ছাড়, হ্রাসকৃত হারে কর প্রদান এবং আয় বাদ দেওয়াকে বোঝানো হয়।
বর্তমানে রেমিট্যান্স, বেতন, শেয়ারের মূলধনী আয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, ডিভিডেন্ট, কৃষি ব্যবসা, সঞ্চয়পত্রের সুদ, সম্পদ হস্তান্তর বা বিক্রি থেকে অর্জিত আয়, রপ্তানি খাতসমূহ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষাসহ বর্তমানে প্রায় শতাধিক খাত কর অব্যাহতির সুবিধা পাচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৭ শতাংশের বেশি। এরমধ্যে রয়েছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ ভ্যাট) আয়কর এবং আবগারি শুল্ক।
৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারকে বেশকিছু শর্ত দেয় আইএমএফ। এরমধ্যে অন্যতম ছিল, চলতি অর্থবছরের মধ্যে কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো। সে অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রাও নেয় এনবিআর।
এনবিআরের সাবেক সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, প্রত্যক্ষ কর অব্যাহতি কমানোর এই কৌশল যৌক্তিক, তবে কঠোরভাবে কমানো হলে সেটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত করতে পারে। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর রূপান্তরের জন্য কর ব্যয় কমানোর একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সাবেক এই আয়কর নীতি সদস্য উল্লেখ করেন যে, চার দশক ধরে কর সুবিধা পেয়ে আসছে তৈরি পোশাক খাত। "এক সময় সেটা যৌক্তিকও ছিল, কিন্তু এসব সুবিধা অনির্দিষ্টকাল অব্যাহত রাখাটা আর ন্যায্য না। এ ছাড়া, এনজিও ও প্রস্তুতকারক খাতসহ কিছু খাত কর অব্যাহতি সুবিধার অপব্যবহার করে, এদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।"
আমিনুল করিম মনে করেন, স্বচ্ছতা বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি আরো ভালোভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য শুধুমাত্র বিশেষ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে।
"এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, কর অব্যাহতিগুলো কমালে কর-জিডিপি অনুপাত অনেকটা বাড়বে। অর্থাৎ, এটি রাজস্ব আদায়ে নতুন গতি আনবে।"
কর অব্যাহতি কমাতে আইএমএফের পরামর্শ
৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির শর্তগুলোর মধ্যে কর ব্যয়কেও যৌক্তিকীকরণ করতে বলেছে আইএমএফ।
গত এপ্রিল মাসে ঢাকা সফর করে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। তাঁদের সাথে এনবিআর কর্মকর্তাদের এক সভার পরে কর অব্যাহতি কমানো বা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছিল।
গত ৮ মে এনবিআরের ওয়েবসাইটে "ট্যাক্স এক্সপেন্ডিচার ইন দ্য ডাইরেক্ট ট্যাক্স অব বাংলাদেশ: এস্টিমেশন অ্যান্ড রিভ্যিউ" (বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে কর ব্যয়: প্রাক্কলন ও পর্যালোচনা) শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে হয়। এতে কর অব্যাহতি কমানো বা সীমা আরোপের পরামর্শ রয়েছে। একইসঙ্গে কর অব্যাহতি পাওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি পরিমার্জন, কর হার সমন্বয় এবং কর-বিষয়ক তথ্য প্রদান ও স্বচ্ছতার উন্নতি এবং সময়ে সময়ে কর অব্যাহতির পর্যালোচনার পরামর্শও রয়েছে।
এ ছাড়া, যেসব ব্যক্তি বা খাত সরকারের কর অব্যাহতির লক্ষ্যের সাথে আর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তাদেরকে অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া বন্ধ করার প্রস্তাবও ছিল প্রতিবেদনে।