জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ফের একদফা বাড়ছে জীবনযাত্রার খরচ
সরকার ফের জ্বালানি তেলের দাম সংশোধন করায় আজ শনিবার (১ জুন) থেকে বাড়ছে অকটেন, ডিজেল, পেট্রোল এবং কেরোসিনের দাম।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কমলেও এ মাসে দেশের বাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেল। অনলাইন পোর্টাল অয়েল প্রাইসের তথ্য অনুযায়ী— গত এক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের গড় মূল্য ব্যারেল প্রতি ৮৮ ডলার থেকে ৮৩ ডলারে নেমেছে।
এদিকে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলছে, বিশ্ববাজারে পেট্রোলিয়ামের দাম কমলেও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে স্থানীয় বাজারে জ্বালানির দাম বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) রাতে এক গেজেট প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ০.৭৫ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা ৭৫ পয়সা; পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ২ টাকা ৫০ পয়সা বাড়িয়ে নতুন দাম ১২৭ টাকা এবং অকটেনের দাম প্রতি লিটারে ২ টাকা ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১৩১ টাকা করা হয়েছে।
আজ থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক খাত ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ভর্তুকি না দিলে আগামী বছরগুলোতে সরকার ও জনগণ— উভয়েরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, "জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মানে সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি। আর এই মূল্যবৃদ্ধি ন্যায্যতার ভিত্তিতে যৌক্তিক পন্থায় করা হচ্ছে না। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে যে যেখানে যেভাবে পারছে পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে। সরকার বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বেধে দিলেও সেই দামে বিক্রি হয় না।"
"সরকার জ্বালানি খাতকে তার বড় আয় ও লাভের খাত হিসেবে দেখে। দেশের শিল্প ও কৃষি খাত যেভাবে জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার শিকার এবং সরকার ভর্তুকি দেবে না বলে সেসব জায়গায় যেভাবে দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে, তাতে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যেই চূড়ান্ত সর্বনাশের শিকার হতে হবে সরকার এবং জনগণ উভয়কেই," বলেন তিনি।
এর আগে, মে মাসেও জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছিল।
৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুযায়ী, গত ৭ মার্চ জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে সরকার নতুন ফর্মুলা চালু করে।এর ভিত্তিতে, সমস্ত পেট্রোলিয়াম জ্বালানি, যেমন— পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন, কেরোসিন, ফার্নেস অয়েল এবং জেট ফুয়েলের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দরের ওপর ভিত্তি করে প্রতিমাসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম তামিম বলেন, "আমাদের বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অর্থনীতিক সমস্যা, সেটা জ্বালানি খাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়।"
তিনি বলেন, "বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের সমস্যা হলো– আমাদনি নির্ভরতার কারণে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থানের দরকার। যেহেতু জ্বালানি খাতে আমাদের আমদানি নির্ভরতা বেশি এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আমাদের টাকার সংকট, ডলারের সংকট রয়েছে, মূলত সে কারণেই বিদ্যুৎ-জ্বালানিখাতে সংকট দেখা দিয়েছে; দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "আসন্ন বাজেটে সরকারের উচিত হবে বিদ্যুৎ খাতের চেয়ে জ্বালানি খাতে বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া। আজ শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে যাচ্ছে, গ্যাস সরবরাহ কমে যাচ্ছে। শিল্পায়ন না হলে বা দেশের শিল্পের উৎপাদন না হলে দেশের উন্নয়ন হয় না, জ্বালানি হচ্ছে অর্থনীতির চালিকা শক্তি, অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে হলে বাকি সবকিছু বাদ দিয়ে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতেই হবে, যাতে আমাদের অর্থনীতি টিকে থাকবে। সুতরাং বর্তমানে আমাদের মূল সংকটই হলো জ্বালানি সংকট।"
"আমরা বিদেশে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি। বিদেশে উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানাকেগুলো আমাদের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের জ্বালানি বিভাগের চাহিদা পূরণের জন্য এ বছর জ্বালানি বিভাগের জন্য কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন," যোগ করেন তিনি।
গত ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারে ঘোষণা দেয়, বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের কারণে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ৭ টাকা বৃদ্ধি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে এক লাফে ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে ১১৭ টাকায় উন্নীত হয়।
তখন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় এতে আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়বে। চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। মূল্যস্ফীতিও আরও বেড়ে যাবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমদানিতে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ টন। মোট চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ডিজেল ব্যবহারে মেটানো হয়। বাকি ২৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেলের মাধ্যমে।
ডিজেল সাধারণত কৃষি সেচে, পরিবহন ও জেনারেটরে ব্যবহার করা হয়। অকটেন ও পেট্রোল বিক্রিতে সব সময় বিপিসি লাভ করে। মূলত ডিজেল বিক্রির ওপরেই বিপিসির লাভ ও লোকসান নির্ভর করে।
জ্বালানি তেলের মধ্যে উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে বিপিসি। আর ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
জ্বালানি বিভাগ জানায়, প্রতিবেশী দেশ ভারত ছাড়াও উন্নত বিশ্বে প্রতি মাসেই জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় বর্তমানে ডিজেল লিটারপ্রতি ৯০.৭৬ রুপি বা ১২৫ টাকা ৭০ পয়সা এবং পেট্রোল ১০৩.৯৪ রুপি বা ১৪৩ টাকা ৯৬ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে সরকার গত ২৯ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি ঘোষণা করে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া চালুর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমলে দেশে কমবে, আবার বাড়লে দেশের বাজারেও বাড়বে।
স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ ফর্মুলার নির্দেশিকায় বলা হয়, দেশে ব্যবহৃত অকটেন ও পেট্রোল ব্যক্তিগত যানবাহনে অধিক পরিমাণে ব্যবহার হয়। তাই বাস্তবতার নিরিখে বিলাসদ্রব্য (লাক্সারি আইটেম) হিসেবে সবসময় ডিজেলের চেয়ে অকটেন ও পেট্রোলের দাম বেশি রাখা হয়।
এছাড়া, ভর্তুকির চাপ এড়াতে ২০২২ সালের আগস্টে গড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। এরপর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২৩ দিনের মাথায় সব জ্বালানি তেল লিটারে ৫ টাকা করে কমানো হয়।