রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কি বাস্তবসম্মত?
প্রস্তাবিত বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে ৫.৪১ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে এককভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমেই ৪.৮০ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর।
যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলতি অর্থবছর প্রথম দশ মাসে মাত্র ২.৮৯ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্যমাত্রা থেকে অন্তত অন্তত ৮২ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে মনে করছে অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিলে ৪.৩০ লাখ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে গত বছরের আদায়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হতে হবে প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ প্রথম দশ মাসে প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশের কিছুটা বেশি। এমন পরিস্থিতিতে লক্ষ্যমাত্রা ২০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪.১০ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাজস্ব আহরণের ট্রেন্ড ও সিপিডির প্রাক্কলন ধরে নিলে চলতি অর্থবছর শেষে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ হতে পারে ৩.৬৮ লাখ কোটি টাকা। ফলে আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যপূরণে এনবিআরকে ৩০.৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রাজস্ব আহরণ করতে হবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এত বেশি হারে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি কোনো বছরই হয়নি। এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ রেভিনিউ গ্রোথ পেয়েছে ২০১৭ সালে।
ওই সময় বৈশ্বিক কিংবা স্থানীয় অর্থনৈতিক সংকট ছিল না বলেই এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে আগামী বছর নানা সংকটের মধ্যেও ৩০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে 'কাল্পনিক লক্ষ্যমাত্রা' বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা বলেন, "যেকোনো লক্ষ্যমাত্রাই অর্থনীতির বাস্তবতা ও অতীত ট্রেন্ড দেখে নিতে হয়। আমাদের রেভিনিউ লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে এসব বিবেচনায় নেয়া হয়নি।"
তিনি বলেন, "এমন একটা সময় এবারের বাজেট হয়েছে যখন সামষ্টিক অর্থনীতি নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের তারল্য সংকট, বাজেট বাস্তবায়নে নিম্ন ও শ্লথ গতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নগামী এবং রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স নিচের দিকে। ফলে চাইলেই এ সময় রাজস্ব আহরণে এ বিপুল প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।"
যদিও অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় জানান, চলমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং অভ্যন্তরীণ সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজস্ব খাতের যুগোপযোগী সংস্কার এবং সেই লক্ষ্যে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন, কর নেট বৃদ্ধি, কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায় এবং প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। যেনো পর্যাপ্ত সম্পদের যোগান নিশ্চিত করা যায়।
এনবিআরের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভ্যাট এবং ইনকাম ট্যাক্স খাতে ১.৭৮ লাখ টাকা করে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে এই দুই খাতে আদায়ের ট্রেন্ড হিসাবে নিলে পরবর্তী দুই মাস এবং আগামী অর্থবছর এনবিআরকে প্রবৃদ্ধি পেতে হবে ৩৬ শতাংশের বেশি।
শুধু এনবিআর নয় নন-ট্যাক্স রেভেনিউয়ের ক্ষেত্রে সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটিও অর্জন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। যদিও নন-ট্যাক্স রেভিনিউ এবং এনবিআর বহির্ভূত ট্যাক্স আহরণ লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী বছর কম নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাবেক সচিব ড. আব্দুল মজিদ বলেন, "আগামী অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি না বাড়লে রাজস্ব আয়ও বাড়বে না।"
তিনি বলেন, "এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দৃশ্যমান কোনো সংস্কার দেখা যাচ্ছে না। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রযুক্তিগত, প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে কাগজবিহীন ও স্বচ্ছ কর পদ্ধতি চালু করা দরকার।"
পরিসংখ্যান বলে, গত এক দশকে বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে গড়ে ১০ থেকে ১৩ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাজেটে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। সরকারের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাকটা অনেক বেশি। ফলে স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদউদ্দীন বলেন, "আমাদের দেশে রাজস্ব ফাঁকির প্রবণতা খুবই বেশি। জিডিপির আয়তন ও প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় রাজস্ব আদায় অনেক কম। বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ১৭ শতাংশ হওয়া উচিত। এটি নিশ্চিত করা গেলে উন্নয়নের অনেক চাহিদাই পূরণ করা সম্ভব।"