সম্পত্তির নিবন্ধন থেকে রাজস্ব বেড়েছে, ২ বছরেই দ্বিগুণ হতে চলেছে
সম্পত্তি নিবন্ধন থেকে সরকারের রাজস্ব আয়– চলতি অর্থবছরের শেষে দুই বছরে প্রায় দ্বিগুণ হতে চলেছে। সরকারের নজরদারি জোরালো হওয়া এবং নিবন্ধন-সংক্রান্ত সেবার মান উন্নয়ন ও সহজগম্য করার ফলেই এমনটা হচ্ছে– বলেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আবাসন বা রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগকারীরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটের বিধান অনুযায়ী প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ থাকবে, এতে সম্পত্তি নিবন্ধন থেকে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি আরো বাড়তে পারে। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বাইরে কর আয়ের প্রধান একটি উৎস হচ্ছে– সম্পত্তি নিবন্ধন।
সরকারি তথ্যমতে, নিবন্ধন খাত থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১৫,১২৪ কোটি টাকার রাজস্ব এসেছে। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে যা ২২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়, সে হিসাবে এটি হবে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির ঘটনা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এরমধ্যে এনবিআরের করের মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব রয়েছে। এনবিআর-বহির্ভূত কর ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাব করা হয়েছে যথাক্রমে- ১৫ হাজার ও ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন- রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করার ভালো সুযোগ ছিল, একারণে গত বছরে প্লট ও ফ্ল্যাটের বিক্রি ভালো হয়েছে। সেখান থেকে সরকারও মোটা অঙ্কের রাজস্ব পেয়েছে।
তিনি বলেন, "২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও আবাসনখাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় আরো রাজস্ব তৈরি হবে। এটা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।"
আইন-মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি এলাকার জমির ন্যূনতম বাজারদরের ওপর এবং প্রকৃত মূল্য অনুসরণ করে দলিল নিবন্ধন কার্যক্রম নিশ্চিত করতে আইন মন্ত্রণালয় বেশ নজরদারি করছে। ফলে রাজস্ব বাড়ছে। একইসঙ্গে, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোকে আরো কর্মদক্ষ করা হয়েছে, ফলে জনসাধারণের জন্য নিবন্ধন অফিসে যাওয়া সহজ হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, সরকার খুব শিগগিরই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নিবন্ধন কার্যক্রমকে অটোমেশনের আওতায় আনবে। এটি পুরো বাস্তবায়ন হলে, রাজস্ব আয় আরো বাড়বে।
জমি, প্লট ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়-বিক্রয় এবং হস্তান্তরের দলিল নিবন্ধন পরিচালিত করে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা- নিবন্ধন অধিদপ্তর। দেশের সবগুলো সাব-রেজিস্ট্রি ও জেলা রেজিস্ট্রারের অফিস পরিচালিত হয় নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীনে।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, জমি, প্লট ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়-বিক্রয় এবং হস্তান্তরের দলিল নিবন্ধন থেকেই মূলত এই রাজস্ব আয় আসে।
ভূমি, প্লট ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়-বিক্রয় নিবন্ধনের জন্য স্ট্যাম্প শুল্ক, নিবন্ধন ফি, অতিরিক্ত কর, উৎস কর ও স্থানীয় সরকার কর হলো এই রাজস্বের উৎস।
রাজস্ব বাড়ার অন্যান্য কারণ
আইন-মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জমি রেজিস্ট্রেশনের উৎসে কর এবং স্থানীয় সরকার কর বাড়ানো হয়েছে। প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে – কম মূল্যে জমি রেজিস্ট্রেশন করানোর প্রবণতা থাকায়– উৎসে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
আগের অর্থবছরে জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় দলিলে লিখিত মূল্যের এক শতাংশ রেজিস্ট্রেশন ফি, এক দশমিক ৫০ শতাংশ স্ট্যাম্প শুল্ক, এলাকাভেদে ২-৩ শতাংশ স্থানীয় সরকার কর দিতে হতো। এ ছাড়া, রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) ও সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) অন্তর্ভুক্ত এলাকার জন্য ৪ শতাংশ, অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকার জন্য ৩ শতাংশ উৎস কর দিতে হতো।
চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেটে জমি নিবন্ধনে উৎসে কর এক শতাংশ বাড়িয়ে – রাজউক ও সিডিএ অন্তর্ভুক্ত এলাকার জন্য ৫ শতাংশ, অন্য সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকার জন্য ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল টিবিএসকে বলেন, "নিবন্ধন খাত থেকে প্রতিবছর রাজস্ব আয় বাড়ার পেছনে দেশের উন্নয়নের প্রভাব, প্রভাবসহ বেশকিছু কারণ রয়েছে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোও বেশ অ্যাকটিভলি কাজ করছে। প্রতিটি এলাকার জমির ন্যূনতম বাজারদরের ওপর এবং প্রকৃত মূল্য অনুসরণ করে দলিল নিবন্ধন কার্যক্রমের ওপর আইন মন্ত্রণালয় বেশ নজরদারি করছে। ফলে রাজস্ব বাড়ছে।"
তিনি বলেন, এখন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে সেবার মান বেড়েছে; এ ছাড়াও পরিবেশ আগের চেয়ে ভালো, ফলে সাধারণ মানুষ নিবন্ধন অফিসগুলোতে সহজেই যেতে পারছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, "নিবন্ধন কার্যক্রম অটোমেশনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে মন্ত্রণালয়। কয়েকটি উপজেলায় পাইলট কার্যক্রম চলছে। সরকার খুব শিগগিরই সারাদেশের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলো অটোমেশনের আওতায় আনবে, এটি পুরো বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব আয় আরো বৃদ্ধি পাবে।"
আইন-মন্ত্রণালয় ও নিবন্ধন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শুধু দলিল নিবন্ধনের জন্য উৎস কর এবং স্থানীয় সরকার কর বাড়ানোর ফলে চলতি অর্থবছরে এত বেশি পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়নি।
তারা বলেছেন, কোভিডের তিন বছর, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের সকল খাতে মন্দা ছিল। কিন্তু, গতবছর দেশের অর্থনীতি সেই মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে শুরু করে, ফলে জমি, প্লট ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তর বেড়েছে। এজন্য রাজস্ব আয়ও আগের বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।
বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআরএসএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি শেখ কাওসার আহমেদ বলেন, নিবন্ধন খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ার মূল কারণ হলো আইন-মন্ত্রণালয়ের কার্যকর তৎপরতা। এখাতের উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ের অনেকগুলো বড় উদ্যোগ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো– জনবান্ধব নিবন্ধন ব্যবস্থা ও সহজতর সেবা।
"ফলে সাধারণ মানুষ কোনো জমি, প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার পর আর দেরী করে না নিবন্ধন কাজ সম্পন্ন করছে। ফলে আগের বছরগুলোর চেয়ে প্রনিয়িত রাজস্ব আয়ও বাড়ছে" - তিনি যোগ করেন।
নিবন্ধন খাতের প্রধান প্রধান উৎস
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সাড়ে ৩৬ লাখ দলিল নিবন্ধন হয়েছে। এরমধ্যে ৩৫ লাখ নিবন্ধিত হয়েছে জমির ক্রয়-বিক্রয়ের সাফকবলা দলিল, জমির দানপত্র দলিল, হেবা দলিল, এওয়াজ দলিল, বণ্টননামা দলিল, অছিয়তনামা দলিল, ডিক্রি ও বায়নাপত্র দলিল।
আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাটের দলিল নিবন্ধিত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার। আর বাকিগুলো বিভিন্ন রকম চুক্তিপত্রের নিবন্ধন এবং পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (আমমোক্তার নিযুক্তির) নথি নিবন্ধন।
এসময়ে কেবল ভূমির দলিল নিবন্ধন থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রয় দলিল নিবন্ধন থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। বাদবাকি অংশ অন্যান্য দলিল নিবন্ধন থেকে আয় হয়েছে।
জাতীয় বাজেটে অবদান
প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ছে। খাত অনুযায়ী ব্যয়ের জন্য জাতীয় বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়, তার যোগান সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করে। কর্মকর্তারা বলছেন, জমি, প্লট ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়-বিক্রয়ের নিবন্ধন থেকে প্রতি অর্থবছরের বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব।
নিবন্ধন খাতের জাতীয় বাজেটে বড় অবদান রাখার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "রাজস্ব সংগ্রহের জন্য সরকার মূলত আয়করের ওপর বেশি নির্ভর করে। তবে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবছরই বিশাল ঘাটতি থাকে। অন্যান্য খাতের মধ্যে কিছু খাতের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও – অনেক খাত থেকেই সেভাবে লক্ষ্য পূরণ হয় না। নিবন্ধন সেক্টরকে গুরুত্ব দিয়ে রাজস্ব আদায় সঠিকভাবে নিশ্চিত করলে– এখাতের প্রবৃদ্ধি আরো হবে।"
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ টিবিএসকে বলেন, এই খাত থেকে আরো কয়েকগুণ রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব।
"সাধারণ মানুষ রাজস্ব কম দিতে– ভূমি বা অন্যান্য কিছুর প্রকৃত মূল্য গোপন করে বেশিরভাগ সময় দলিল নিবন্ধন করে। অনেকসময় সরকার নির্ধারিত জমির ধরন ও মৌজা অনুসারে, নির্ধারিত ন্যূনতম বাজারদর ধরে দলিল নিবন্ধন করা হয়। এভাবে করসহ নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত অন্যান্য ফি অনেকটাই ফাঁকি দেয়।"
তিনি আরও বলেন, "এখন বিভিন্ন জমির ধরন ও মৌজার ন্যূনতম যে বাজারদর সরকার নির্ধারণ করেছে, সেটিও সঠিক নয়। বেশিরভাগ এলাকায় নামমাত্র দর নির্ধারণ করা থাকে। সরকার যদি যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে প্রতিটি এলাকার জমির যৌক্তিক ন্যূনতম বাজারদর নির্ধারণ করে, তাহলে রাজস্ব আয় আরো বাড়বে।"