বিদেশি জাহাজে পণ্য পরিবহনে ওয়েভার সনদের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করেছেন আদালত
ওয়েভার সনদ ছাড়া বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বাধ্যবাধকতার বিষয়টি ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেছেন উচ্চ আদালত।
ফলে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনে এখন থেকে বিদেশি পতাকাবাহী কনটেইনার জাহাজগুলোকে মার্কেন্টাইল মেরিন অফিস (এমএমও) থেকে কোন এনওসি বা ওয়েভার সার্টিফিকেট নিতে হবে না।
বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের দায়ের করা এক রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার (১১ জুন) হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমানের যৌথ বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একইসাথে ওয়েভার সার্টিফিকেট নেওয়ার বাধ্যতামূলক ধারাগুলো কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না– তার কারণ দর্শানোর জন্য রুল জারি করা হয়।
ওই রিটে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, নৌ বাণিজ্য দপ্তরের মুখ্য কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে প্রতিপক্ষ করা হয়।
রিটের তিন নম্বর প্রতিপক্ষ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বিদেশি জাহাজের পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ওয়েভার সার্টিফিকেট না দেখারও নির্দেশ দেয়া হয়।
বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজকে অগ্রাধিকার দিতে সরকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন, ২০১৯ ( ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অ্যাক্ট) প্রণয়ন করে। ওই আইন অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে পরিবহন হওয়া পণ্যের ৫০ শতাংশ পণ্য বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজে পরিবহন করতে হবে।
ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অ্যাক্ট' এর আলোকে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ স্বার্থরক্ষা বিধিমালা ২০২৩ প্রণয়ন করে সরকার। বিধিমালা অনুযায়ী, মার্কেন্টাইল মেরিন অফিস থেকে ওয়েভার সনদ নেওয়া ছাড়া পণ্য পরিবহন বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
এই বিধিমালা জারির পর চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিভিন্ন ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর যেমন সিঙ্গাপুর, পোর্ট কেলাং, কলম্বো বন্দরে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বিদেশি জাহাজগুলো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে। জাহাজের বুকিং থাকা সত্ত্বেও পণ্য বোঝাই না করে বন্দর ত্যাগ করতে হয় তাদের। ওয়েভার সনদ ছাড়া পণ্য পরিবহন করায় মার্কেন্টাইল মেরিন অফিস বেশকিছু জাহাজকে পরিমানাও করে।
ওয়েভার সনদ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পণ্য পরিবহনের দায়ে এক্সপ্রেস লোটসে জাহাজকে ৭২ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে মার্কেন্টাইল মেরিন অফিস (এমএমও)। জরিমানা না দেওয়ায়, গত ১৫ মে কলম্বো বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজটিকে আটক করে এমএমও। পরবর্তীতে জরিমানা দিয়ে ছাড়া পায় লাইবেরিয়ার জাহাজটি। ওই জাহাজের স্থানীয় শিপিং এজেন্ট সী কনসোর্টিয়াম।
বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি সামছুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'ওয়েভার সনদের নামে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। বিদেশি শিপিং কোম্পনিগুলোর জাহাজ পণ্য বুকিং থাকা সত্ত্বেও পণ্য পরিবহন করতে পারছিল না। এর প্রভাবে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট রুট থেকে জাহাজ প্রত্যাহার করে নেওয়ারও ঘটনা ঘটে। উচ্চ আদালতের এই আদেশের ফলে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের বাধা দুর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমরা আশা করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর আদালতের এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবেন।'
মার্কেন্টাইল মেরিন অফিসের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
এদিকে বিজিএমইএ এবং বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, মার্কেন্টাইল মেরিন অফিসের প্রিন্সিপাল অফিসারকে গত ১৩ জুন একটি চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের ওয়েভার সনদ নেওয়ার বাধ্যবাধকতাকে বেআইনি বলে অভিহিত করা হয়।
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম, 'উচ্চ আদালতের আদেশের কপি আমরা এখনো হাতে পাইনি। তাই এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। বিজিএমইএ এবং কন্টেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের চিঠিও আমরা পাইনি।'
এর আগে ওয়েভার সনদ নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিলও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। আইনটির বেশকিছু ধারা ও শর্ত শিথিল করার আহ্বান জানিয়েছিল সংগঠনটি।
বিদেশি জাহাজ মালিকদের সংগঠনের পাশাপাশি দেশের তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র পক্ষ থেকেও আইনের কড়াকড়ির ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বিজিএমইএ'র থেকে অরজিন টু অরজিন পণ্য পরিবহনের মধ্যে ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অ্যাক্ট সীমাবদ্ধ রাখার জন্যও পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।