কাঁচা চামড়া সংগ্রহের জন্য ২৭০ কোটি টাকা ঋণ পাবে ট্যানাররা
আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয় ও কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে ট্যানাররা ২৭০ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ পাবে বলে জানা গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত এ ঋণের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ১০ কোটি টাকা বেশি। ১২টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ বিতরণ করা হবে।
চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেবে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক—সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী। বাকি ঋণ দেবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
বিগত বছরগুলোর মতো এবারও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) গত বছরের চেয়ে বেশি ঋণ সহায়তা চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে।
গত বছর ব্যবসায়ীরা অন্তত ৫০০ কোটি টাকা ঋণ চাইলেও পেয়েছেন তার মাত্র অর্ধেক, ২৫৯ কোটি টাকা। তবে ২০২২ সালে ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল, ৪৪৩ কোটি টাকা।
মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহায় প্রায় এক কোটি পশু কোরবানি দেওয়া হয়। এ মৌসুমে সংগ্রহ করা এই কাঁচা চামড়ার বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
গত ১২ মে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের সভাপতিত্বে এক সভায় বিটিএ সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ বলেন, 'কাঁচা চামড়া ক্রয় ও সংরক্ষণের জন্য কোরবানির আগে বার্ষিক যে ঋণ দেওয়া হয়, এটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। শিল্পমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, পর্যাপ্ত ঋণ দিতে মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'আমরা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রতিবছর যেসব ব্যাংক এই খাতে ঋণ দেয়, তারা এবার ২৭০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে।'
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'ট্যানারিগুলো এই ঋণ নিয়ে অনেক সময় ঋণ যথাসময়ে ফিরত দেয় না। এই খাতে ব্যাপক পরিমাণে ঋণ খেলাপি অবস্থায় রয়েছে। যার কারণে ব্যাংকগুলোরও ইচ্ছে কম এই খাতে বিনিয়োগ করা।'
শাহীন আহমেদ বলেন, 'এখন পর্যন্ত চামড়া খাতে বকেয়া ঋণ ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রুপের একাই ৫ হাজার কোটি টাকা, বাকি সব ট্যানারিগুলোতে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ বকেয়া আছে। এ বছর আমরা ১৭০ কোটি টাকার ঋণ রিশিডিউল করেছি।'
তিনি বলেন, 'চামড়া একটি পচনশীল পণ্য, যা দ্রুত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হয়। সারা দেশ থেকে বিভিন্ন আড়তের মাধ্যমে সংগৃহীত চামড়া কিনতে হয়—যার জন্য নগদ টাকা প্রয়োজন হয়, কারণ মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে আড়তে বিক্রি করেন।'
বিটিএ সভাপতি আরও বলেন, 'ট্যানারি মালিকরা নিজস্ব ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দিয়ে ব্যবসা করলেও কোরবানির সময় বেশি নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়, যা নিজস্ব ফান্ড থেকে ম্যানেজ করা সম্ভব হয় না।'
বিটিএ চামড়া খাতের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংস্থা। এ খাতের শিল্পমালিকরা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারিতে প্রক্রিয়াজাত করেন।
প্রক্রিয়াকরণের পর কিছু চামড়া এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পে বিক্রি করা হয় এবং বাকি চামড়া বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
বিটিএর তথ্যমতে, বর্তমানে ট্যানারি মালিক ও বাণিজ্যিক রপ্তানিকারক মিলিয়ে সংস্থাটির সদস্যসংখ্যা প্রায় ৮০০। সারা দেশে ১ হাজার ৮৬৬ জন বড় ও মাঝারি চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছে।
এর বাইরে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঈদুল আজহায় পশুর চামড়া সংগ্রহ করেন, এমন অনেক এজেন্ট আছেন।
রাজধানীর পোস্তা, নাটোরের রেলওয়ে বাজার, যশোরের রাজারহাট, গাইবান্ধার পলাশবাদী, রংপুরের তারাগঞ্জ, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, আমিনবাজার ও টঙ্গী-গাজীপুরের আড়তগুলোতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মজুত করা হয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ২০০টি ট্যানারি আছে। এর মধ্যে ১২৭টি ট্যানারি আছে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ২০১৭ সালের পর থেকে ট্যানাররা ভালো নেই। যার দরুন অনেক ব্যবসায়ী খেলাপির তালিকায় পড়েছেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে চামড়া শিল্পে যাদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগের ঋণই ঋণ পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। তাই এ খাতের ব্যবসায়ীরা এখনো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
বিটিএর সাবেক একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'ব্যাংকগুলো চামড়া শিল্পে ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। চামড়া মালিকরা আশানুরূপ ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ দেয়, তা বিগত বছরের ঋণের সাথে সমন্বয় করে (ঋণ পুনঃতফসিল)। এতে গত কয়েক বছর যাবত চামড়া শিল্প মালিকদের হাতে এ খাতের ঋণের টাকা আসে না।'
তিনি আরও বলেন, '২০১৭ সালের আগে কিন্তু এ খাতের অধিকাংশ ব্যাবসায়ী খেলাপি ছিলেন না। সাভারে চামড়া শিল্পে স্থানান্তর হয়ে উৎপাদনে যাওয়ার মতো সক্ষমতা অনেক ব্যবসায়ীর ছিল না। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, বিগত দুই বছরের (২০১৭-২০১৯) ঋণের সুদ যেন মওকুফ করে দেওয়া হয়।'
চামড়া রপ্তানি কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি
২০১৭ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলোকে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর করা হয়। কমপ্লায়েন্স ইস্যু ও স্থানান্তরের কারণে চামড়া রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, ফলে রপ্তানি কমে যায়।
তবে গত কয়েক বছর ধরে চামড়া রপ্তানিতে গতি বাড়ছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এগারো মাসে (জুলাই-মে) চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে ৯৬১ মিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪.১৭ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ডলার।