রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫৮৭ মিলিয়ন ডলার বকেয়া সুদ নিষ্পত্তিতে বিকল্প পদ্ধতি খুঁজছে বাংলাদেশ
রাশিয়ার ব্যাংকের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মাঝে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য রাশিয়ান ঋণের বকেয়া সুদ, কমিটমেন্ট ফি ও বিলম্ব জরিমানার ৫৮৭ মিলিয়ন ডলার দায় নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ বিকল্প লেনদেনের উপায় খুঁজছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, দেরিতে পাওনা পরিশোধের কারণে রাশিয়ার আরোপিত ২ দশমিক ৪ শতাংশ জরিমানার পর অর্থ পরিশোধ সমস্যার সমাধান খোঁজার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে।
সরকার রাশিয়ার কাছে প্রস্তাব করেছে, পাওনা আদায়ের পরিবর্তে রাশিয়া ওই অর্থ বাংলাদেশে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনার বিষয়ে বিবেচনা করতে পারে।
সুদ পরিশোধ ছাড়াও ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলারের রাশিয়ান ঋণের প্রথম কিস্তি (আসল) ২০২৭ সালের মার্চে পরিশোধের কথা থাকলেও বাংলাদেশ ২০২৯ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব এবং ইআরডির ইউরোপ উইংয়ের প্রধান উত্তম কুমার কর্মকারের সভাপতিত্বে গতকাল (২৪ জুন) এক ভার্চুয়াল আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বকেয়া সুদের অর্থ প্রদানের এসব বিকল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বলে টিবিএসকে জানিয়েছে বৈঠকে উপস্থিত সূত্র।
রাশিয়া ও তাদের বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাংলাদেশ সরকার এ অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। ইআরডি আগামী রোববার বা সোমবার রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা করছে। জরিমানার চাপ এড়ানোর উদ্দেশ্যে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ কীভাবে তাদের পাওনা অর্থ নেবে তা জানতে চাইবে ইআরডি।
পরিশোধের সম্ভাব্য বিকল্প পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে ইআরডি-র অতিরিক্ত সচিব উত্তম কুমার কর্মকার টিবিএসকে বলেন, 'পাওনা পরিশোধের কোনো পদ্ধতি এখনও ঠিক হয়নি।'
তিনি এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।
বৈঠকে উত্তম কুমার বলেন, রাশিয়ান পক্ষের ধারণা, বাংলাদেশের কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা বা তহবিলের অভাব রয়েছে। তাদের এ ধারণা তার কাছে [রাশিয়ান পক্ষের] কেউ কেউ প্রকাশও করেছেন।
সরকার অবশ্য আশা করছে, রাশিয়া বিকল্প ঋণ পরিশোধের প্রস্তাবে রাজি হবে।
সভায় উপস্থিত থাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মঈনুল ইসলাম তিতাস টিবিএসকে বলেন, 'যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বকেয়া নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে। বিকল্প বিভিন্ন উপায় খোঁজা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, উভয়পক্ষ মিলে শিগগিরই একটি বিকল্প বের করা সম্ভব হবে।'
বৈঠকে উত্তম কুমার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক সময় নিলেও এ লেনদেন সম্পন্ন করার কোনো উপায় বের করতে পারেনি। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে ঋণ পরিশোধের কার্যকর বিকল্প খুঁজে বের করতে এবং ইআরডিকে জানাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পরিশোধের বিকল্প উপায় কী কী আছে?
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তাব করেছে, পাওনা আদায়ের পরিবর্তে রাশিয়া বাংলাদেশে ওই অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে, বিশেষ করে জ্বালানি তেল শোধনাগার স্থাপনের মতো প্রকল্পে।
এছাড়া রাশিয়া বাংলাদেশের শেয়ার বাজারেও বিনিয়োগ করতে পারে অথবা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে পারে, যার দাম বাংলাদেশের রপ্তানিকারককে এ অর্থ থেকে পরিশোধ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক আমিনুর রহমান চৌধুরী বলেন, গত মে মাসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসব প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।
ইআরডি প্রস্তাব করেছে যে, রূপপুর প্রকল্পের পাওনা অর্থ রাশিয়া নতুন কোনো প্রকল্পে বাংলাদেশকে ঋণ হিসেবে দিতে পারে।
রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পসূত্রে জানা গেছে, সরকার রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়নের জন্য রাশিয়া থেকে ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে।
এ ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ করার কথা ২০২৭ সালে ১৫ মার্চ। যদিও সরকার বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের প্রেক্ষিতে ঋণের আসল দুই বছর পর ২০২৯ সালের ১৫ মার্চ পরিশোধ করতে চাচ্ছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠানো হয়েছে।
বর্তমানে রাশিয়ান পক্ষের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৪৮০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি সুদ ও কমিটমেন্ট ফি এবং ১০৭ মিলিয়ন ডলার বিলম্ব জরিমানা। কিন্তু রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এ অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।
দেরি কেন?
বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক আমিনুর রহমান বলেন, রাশিয়ার পুরো পাওনা আলাদা করে রাখা আছে। পরিশোধের সুযোগ হলেই তা দিয়ে দেওয়া হবে। সরকার ইতোমধ্যে রাশিয়াকে এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে।
রূপপুর প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সরকার-টু-সরকার চুক্তির অধীনে রাশিয়ার জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংস্থা ভিইবি.আরএফ-এর মাধ্যমে ঋণের সুদ পরিশোধের উদ্দেশ্য ছিল। তবে প্রতিষ্ঠানটিকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
যদিও রাশিয়া দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার মাধ্যমে ইউয়ানে ঋণ নিষ্পত্তির প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতার কারণে এ পদ্ধতিও আটকে আছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের বার্তাপ্রেরক মাধ্যম সুইফটের বিকল্প সিআইপিএস ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে চীন। নতুন এ পদ্ধতিতে এখনও যুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ।
বৈঠকে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহেদুল হাছানসহ ইআরডি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তারা উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ করায় এ সুদ ও কমিটমেন্ট ফি পরিশোধে বাংলাদেশ সরকারের জরিমানার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ এবং ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক আমিনুর রহমান বলেছেন, আন্তর্জাতিক লেনদেন বাস্তবায়নের মাধ্যম সুইফট সিস্টেমের বাইরে গিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থায় চীনা মুদ্রায় রাশিয়ান পাওনা পরিশোধের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক চীনের সিআইপিএস-এ যুক্ত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সিআইপিএ এখনও কার্যকর না হওয়ায় সুইফটের বাইরে কোনো লেনদেন না করার জন্য গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান আরেক কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকজন অতিরিক্ত পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নেবে, তাদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে — যুক্তরাষ্ট্রের এমন ইঙ্গিতের কারণে বকেয়া পরিশোধ আরও জটিল হয়ে পড়েছে।
ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্টের অতিরিক্ত পরিচালক রোকসানা আকতার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কিছু ব্যাংককে নিষেধাজ্ঞা না দিলেও বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। ওইসব ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতেও অসুবিধা হচ্ছে।
স্থানীয় রাশিয়ান ঠিকাদারদের সময়মতো অর্থ পরিশোধ করা হয়নি
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মঈনুল ইসলাম তিতাস রূপপুর প্রকল্পে কাজ করা রাশিয়ান স্থানীয় ঠিকাদারকে পাওনা পরিশোধে বিলম্বের কথা বৈঠকে তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, এ পাওনা পরিশোধের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সোনালী ব্যাংককে ১০০ কোটি টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর করতেও বেশি সময় লাগছে। এতে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের ধারণা হচ্ছে, বাংলাদেশ তাদের পাওনা সময়মতো পরিশোধে অপারগ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমিনুর রহমান আরও বলেন, রাশিয়ার স্থানীয় ঠিকাদারদের পাওনা পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সহায়তা করছে। ১৫ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের অর্থপ্রদানের জন্য সোনালী ব্যাংককে ৬৯ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে।