রপ্তানি তথ্যের গরমিল কীভাবে হলো? এনবিআর না ইপিবি – দায় কার?
রপ্তানির তথ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের গরমিল ধরা পড়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) – কোন পক্ষই এর দায় নিজেদের কাঁধে নিতে চাচ্ছে না। ফলে ব্যাপক এই ত্রুটি কীভাবে ঘটলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
তবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো টিবিএসকে বলেছে, একই রপ্তানি চালানের তথ্য এনবিআরের কাস্টমস বিভাগ একাধিকবার 'এন্ট্রি' করার কারণেই তথ্যের এই অসঙ্গতি তৈরি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ইপিবি'র কর্মকর্তারা এজন্য রাজস্ব কর্তৃপক্ষকে দায় দিচ্ছেন। তারা বলছেন, এনবিআরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তারা রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে, এনবিআর কর্মকর্তারা এবিষয়ে সরাসরি কোনো কথা বলছেন না। দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ করে কথাও বলতে চাচ্ছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজস্ব বোর্ডের সিনিয়র একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "ডাবল কাউন্টিংয়ের কারণে রপ্তানির তথ্যে এ গ্যাপ (প্রকৃত রপ্তানির সাথে পার্থক্য) তৈরি হয়েছে।"
এক্ষেত্রে এনবিআরের রপ্তানি-সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণকারী সফটওয়্যারের কারণেও তা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, "এনবিআরের দিক থেকেই একাধিকবার গণনার ফলে এ সমস্যা হয়েছে এবং তারা এটি স্বীকারও করেছেন। তাদের (এনবিআর কর্মকর্তাদের) নিজস্ব পর্যালোচনাতেও এমনটি উঠে এসেছে।"
এনবিআর ত্রুটি সংশোধনের ব্যবস্থা নিচ্ছে" জানিয়ে তিনি বলেন, "আমরা (ইপিবি) সেকেন্ডারি ডেটার ওপর নির্ভর করতাম। এখন থেকে নিজেরাও কেয়ারফুলি ডেটা চেক করব। তথ্য পেলাম আর প্রকাশ করে দিলাম – তা করবো না।"
"এবিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইপিবিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে" – বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও তথ্যের গড়মিলের জন্য এনবিআরকেই দায়ী করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র নির্বাহী বলেছেন, এনবিআর যেহেতু রপ্তানি তথ্য প্রদানের প্রাথমিক উৎস – তাই তথ্য এন্ট্রির অসামঞ্জস্যের জন্যও জবাবদিহির সম্পূর্ণ দায়ভার তাদেরই। এই গড়মিল আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি তৈরি করেছে।
অবশ্য এনবিআরের অপর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা পরিসংখ্যানের ত্রুটির দায় পুরোটাই নিজেরা নিতে নারাজ। তিনি বৃহস্পতিবার টিবিএসকে বলেন, "অনেক সময় স্যাম্পল পাঠানো, ডিসকাউন্টেড বা রিজেক্টেড পণ্য রপ্তানি থেকে বাদ না দেওয়ায়– তা রপ্তানি হিসেবে গণ্য হয়। এটি কাস্টমসের হাতে নয়। কেননা রপ্তানি হলে ওই তথ্য এনবিআর প্রকাশ করে।
"এছাড়া, দেশের অভ্যন্তরে থাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)-গুলোর বাইরের প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি-ও রপ্তানি হিসেবে গণ্য হয়" – জানান তিনি।
এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের অপর আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, "এনবিআরের কাস্টমসে জনবল সংকট আছে। আমাদের জনবলের ৮০ শতাংশের বেশির নজর থাকে মূলত আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে। ফলে রপ্তানি পণ্যের যথাযথ মনিটরিং করাটা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং।"
আমদানির ন্যায় রপ্তানিতে সরাসরি রাজস্ব সংশ্লিষ্টতা নেই। ফলে রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচারের ঝুঁকি থাকছে বলেও জানান তিনি।
তবে যে কারণেই হোক, রপ্তানির তথ্যে ব্যাপক এ ভুল হিসাব দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বহু হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশ করা তথ্য নিয়ে বৈশ্বিক অঙ্গণে নতুন করে প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কেবলই পদ্ধতিগত ভুল, নাকি আরো বড় কিছু?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "পুরো প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত। এটি নিছকই পদ্ধতিগত ভুল, নাকি তার চেয়ে বেশি কিছু? দেখা উচিত এর মাধ্যমে কেউ সুবিধা নিয়েছে কিনা।"
"এই ভুলের আড়ালে কেউ প্রণোদনার সুবিধা কিংবা টাকা পাচার করেছে কিনা – তা দেখতে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা উচিত" – বলেন তিনি।
এসব বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিমের সাথে মুঠোফোনের যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় টিবিএস।
এছাড়া এনবিআর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বহুল আলোচিত এবিষয়ে গণমাধ্যমকে কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি।
একই কাস্টমস কোড ব্যবহার করবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবি
গত ২৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় রপ্তানির প্রকৃত চিত্র দেখানোর লক্ষ্যে সব পক্ষ এনবিআর সরবরাহকৃত অভিন্ন কাস্টমস প্রসিডিউর কোড (সিপিসি) ব্যবহার করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নির্ধারিত সিপিসি ফলো করলেও– ইপিবি'র সঙ্গে তা মেলে না।
এছাড়া এনবিআর কর্তৃক পাঠানো সংশোধিত তথ্যের ভিত্তিতে ইপিবি ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রপ্তানির তথ্য সংশোধন করবে, এবং রপ্তানির তথ্য প্রকাশের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের সাথে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করবে বলেও সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়।
সংশোধিত তথ্য প্রকাশ নিয়ে বিপাকে ইপিবি
ইপিবি'র একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আমাদের বলা হয়েছে, গত দুই অর্থবছরের সংশোধিত ডেটা প্রকাশ করার জন্য। এনবিআরের কাছ থেকে সংশোধিত তথ্য পাওয়ার পর এটি আমরা তৈরি করব। কিন্তু এতে কমপক্ষে একমাস সময় লাগবে।"
ওই কর্মকর্তা বলেন, "কিন্তু এটি প্রকাশ করা হলে আমাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। সংশোধিত তথ্য প্রকাশের পর এতদিন যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে এসেছি, কীসের ভিত্তিতে তার পরিবর্তন করা হলো – সে প্রশ্ন উঠবে।"
"এ বিষয়ে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব" – বলেন তিনি।