১৫ বছরে বৈদেশিক ঋণের দায় বেড়েছে ২৮৩.৪২%
সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার, তার গত ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতিমাসে গড়ে ৪০৩ মিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে; এতে করে প্রতিমাসে বিদেশি ঋণদাতাদের কাছে ৪,৮৪২ কোটি টাকা ঋণী হয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিদিনের হিসাবে এই ঋণের পরিমাণ ১৬১ কোটি টাকারও বেশি।
বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ২৪২.৫৬ শতাংশ। ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণও ২৮৩.৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
২০০৯ সালে যখন প্রথমবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, ওই বছর সরকার আসল ও সুদ বাবদ ঋণ পরিশোধ করেছিল ৮৭৫.৫৮০ মিলিয়ন ডলার, যা ১৫ বছরে বেড়ে হয়েছে ৩.৩৫৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ইআরডি তথ্য অনুযায়ী, ১৫ বছরে আসল পরিশোধ বেড়েছে ১৯৩ শতাংশ, আর সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৬০৯ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকার, উন্নয়ন সহযোগীদের আসল বাবদ পরিশোধ করেছে ৬৮৫.৭৪০ মিলিয়ন ডলার, আর গত অর্থবছরে আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ২.০০৯ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৮৯.৮৪০ মিলিয়ন ডলার। এবং গত অর্থবছরে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১.৩৪৭ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতা আসার পর থেকে অনেক বড় ব্যয়ের মেগা প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল এমআরটি–৬, পদ্মা রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, হযরত শাহজালার বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিলানসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয়েছে বা বাস্তবায়ন কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ কারণে বড় প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড়ও বেড়েছে।
বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণ দায় বাড়ছে। মেগা প্রকল্প ছাড়াও কোভিড পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও সরকার বাজেট সহায়তা নিয়েছে। গত ৫ বছরে সরকার বাজেট সহায়তা ঋণ নিয়েছে ৮.৪৮ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ ও বাজেট সহায়তা ঋণের প্রভাবে বৈদেশিক ঋণের দায় বা বকেয়া বেড়েছে বলে জানায় ইআরডির কর্মকর্তারা। ঋণের দায় বেড়ে যাওয়ার কারণে সুদ ও আসল পরিশোধও ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারেরর বৈদেশিক ঋণের দায় ছিল ২০.৩৩৬ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সরকারের বৈদেশিক ঋণের দায় ৬৯.৬৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, বড় ব্যয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেস পিরিয়ডও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আসল পরিশোধ বেড়েছে।
সুদহার বেড়ে যাওয়ার জন্য বাজার-ভিত্তিক ঋণের বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করছে ইআরডি। কারণ গত বছর থেকে সিকিওরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিয়াল রেট (সোফার) বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সোফার সুদহার বেড়েছে।
ইআরডির কর্মকর্তারা আরো জানান, ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতে সিকিওরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিয়াল রেট বেড়ে গিয়ে বর্তমানে এই রেট এখন ৫ শতাংশের বেশি— যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও ১ শতাংশের কম ছিল।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের বাজার-ভিত্তিক ঋণ ক্রমগত বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশকে এখন সুদ বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের জন্য সবচেয়ে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে যে ঋণ পাওয়া যায়, তার প্রায় ৭৫ শতাংশই বাজার-ভিত্তিক ঋণ। এছাড়া এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে বাজার-ভিত্তিক সুদে ঋণ নেওয়া হয়। একইসঙ্গে, বিশ্বব্যাংক থেকে স্বল্প পরিসরে বাজার-ভিত্তিক ঋণ নেয় বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত কয়েক বছরে আমরা অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়— রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, সরকারের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণের রূপপুর প্রকল্পও রয়েছে।"
তিনি বলেন, "এখন অনেক কিছুই উঠে আসছে। জানা গেছে, সোভিয়েত যুগের প্রযুক্তি, আবার এ প্রকল্পে ৫ বিলিয়ন ডলার দুর্নীতির কথাও এখন শোনা যাচ্ছে। এর আগে, এই প্রকল্পে বালিকাণ্ডের মতো দুর্নীতির কথাও বের হয়ে এসেছে। এ ধরনের মন্দ প্রকল্পগুলো আমাদের ঋণের দায় বাড়বে।"
তিনি আরও বলেন, "এখন বৈদেশিক ঋণগুলোকে অনেক দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে বলেই শেষ করতে হবে, তার মানে হয় না। যা খরচ হয়ে গেছে, তাতো আমাদের পরিশোধ করতেই হবে। কারণ ঋণ নিয়েছে রাষ্ট্র। কিন্তু কুশাসনের এবং অনিয়মের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদেরও কাছ থেকেই এই অর্থ আদায় করা দরকার।"
তিনি বলেন, "এখন বৈদেশিক ঋণের প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কৌশলী হতে হবে। অর্থনীতিতে উপযোগীতা আছে, এমন প্রকল্পই বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন জন্য নিতে হবে। যেমন –ঢাকা –চট্টগ্রাম ৬ লেনের প্রকল্প। এই প্রকল্পের নকশা যদি সঠিকভাবে করা যায়, এই প্রকল্প অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।"
বিশেজ্ঞদের মতে, গত ১৫ বছরের যে পরিমাণ ঋণের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, তারমধ্যে ৪৪.৬৯ বিলিয়ন ডলার পাইপলাইনে আছে। প্রকল্প বাস্তবায়য়নের সঙ্গে সঙ্গে এইসব ঋণ ছাড়া হবে। সেইসঙ্গে পরিশোধও বাড়বে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাজস্ব আদায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার যোগান যদি না বাড়ে, তাহলে ঋণ পরিশোধের চাপে অর্থনীতিতে দুর্দশা নেমে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে যে অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে, তার ব্যয় বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বেশি বলেও অভিযোগ রয়েছে। গত সোমবার পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের অনেক প্রকল্প আছে, ইউনিট প্রতি ব্যয় বিশ্বের আরেক দেশের চেয়ে বেশি। সড়কসহ অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পে এটি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রকৌশলী ড. শামসুল হক বলেন, "আগের সরকার বিদেশি ঋণ নিয়ে অনেক অবকাঠামো তৈরি করেছে, যেগুলোর নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বেশি। যেমন– মেট্রোরেল। জাপানের অর্থায়নের ইন্দোনেশিয়াও মেট্রো তৈরি করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে জাপানের অর্থায়নের মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি।"
তিনি বলেন, "আমাদের প্রতিবেশী অনেক দেশই আমাদের চেয়ে কম খরচে এ ধরনের অবকাঠোমো নির্মাণ করেছে। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে ঠিকাদাররা। ফলে যে ঋণের অর্থ দিয়ে আমরা যেখানে একটি অবকাঠামো নির্মাণ করছি, সেখানে একই পরিমাণ বিদেশি ঋণ দিয়ে অনেক দেশ একই ধরনের দুটি অবকাঠামো নির্মাণ করেছে।"
বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে এ বিষয়ে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।