শেয়ারবাজারে এখন পীর-দরবেশ নেই, কিন্তু তাদের মুরিদরা এখনও আছে: বিএসইসি তদন্ত কমিটি
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির সদস্য ইয়াওয়ার সাঈদ বলেছেন, ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্তে অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছিল; কিন্তু সেই তদন্তের ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এবং দোষীদের কাউকে শাস্তিও দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, 'সেই সময় ক্যাপিটাল মার্কেটে অনেক পীর-দরবেশ ছিলেন, যাদের প্রভাব এখন কমে গেছে, কিন্তু তাদের মুরিদরা এখনও আছেন। আমাদের কাজ তাদের খুশি না-ও করতে পারে।'
সোমবার (০২ সেপ্টেম্বর) বিএসইসি কার্যালয়ে তদন্ত কমিটিবিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
ইয়াওয়ার সাঈদ আরও বলেন, 'আমাদের কাজের ফলাফল অনুযায়ী আমাদের বিচার করুন। ১১ কর্মদিবসে বিএসইসি এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।'
বছরের পর বছর ধরে শেয়ারবাজারে চলে আসা অনিয়ম ও দুর্নীতি মোকাবিলায় বিএসইসির সাম্প্রতিক প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে এসব মন্তব্য করেছেন তিন।
নিজের দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে গিয়ে সাঈদ শেয়ারবাজারে কারসাজি নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইবরাহিম খালেদের প্রতিবেদনের উল্লেখ করেন। ইবরাহিম খালেদের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, দুজন ব্যক্তিকে পুঁজিবাজার থেকে পারসনা নন-গ্রাটা (অবাঞ্ছিত) করতে হবে। 'সেটা করা হয়নি। বরং তারা এই শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করেছেন।'
'তবে সেই রিপোর্ট আমাদের কাছে পাবেন না। আমরা যে কাজ করতে এসেছি, তা-ই করব। যদি ব্যর্থ হই, তাহলে সরে যাব। আমাদের কাজে বাধা দেবেন না,' সাঈদ বলেন।
ইয়াওয়ার সাইদ আরও বলেন, ১৯৯৯ সালের ২৯ আগস্ট প্রথম মিউচুয়াল ফান্ডের উদ্বোধন করা হয়। এরপর ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই খাত ২৫ কদমও এগোয়নি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঋণাত্মক হয়েছে।
তিনি বলেন, 'বিগত বছরগুলোতে যেসব অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে শেয়ারবাজারে, সেগুলো সাংবাদিকরা রিপোর্ট করেছেন। এখন এসব রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত করব।
'আমরা এখন আছি, এখানে কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। এখন কোনো এমপি-মন্ত্রী আমাদের বলবেন না, ওর নামে রিপোর্ট কোরো না। আমরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করব। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ হব। মানুষ যেন আমরা মরে গেলেও বলে যে মার্কেটের জন্য কিছু লোক কাজ করে গেছে।'
অনুষ্ঠানে বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার প্রতি কমিশনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, বিগত বছরে ঘটে যাওয়া ১২টি অনিয়ম খতিয়ে দেখতে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের কাছে তারা নির্দিষ্ট অনিয়মের প্রমাণ চান—এবং এই প্রমাণগুলো এমন হতে হবে যা 'আইনি প্রক্রিয়ায় কার্যকর' হিসেবে বিবেচিত হবে।
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করবে। তাড়াহুড়ো করে কোনো অসম্পূর্ণ কাজ করা হবে না।
তদন্ত কমিটির ৫ জন সদস্যের মধ্যে দুজন বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—এমন প্রশ্নের জবাবে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, 'যেখানেই যাই না কেন, কারও না কারও সঙ্গে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক থাকতেই পারে।
'তবে আমাদের তদন্ত কমিটি যদি তদন্ত করতে গিয়ে কোনো সদস্যের স্বার্থের সংঘাতের বিষয়টি খুঁজে পায়, তাহলে সেই সদস্য সেই নির্দিষ্ট বিষয়ে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। কমিটির বাকি সদস্যরা তদন্ত চালিয়ে যাবেন। এটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া, যা সারা দুনিয়ায় অনুসরণ করা হয়।'
রাশেদ মাকসুদ আরও বলেন, 'শেয়ারবাজার সামনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই কমিশন গঠনের ১১ দিনের মধ্যেই আমরা এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভবিষ্যতে আরও অনেক কাজ করব, এটাই স্পষ্ট বার্তা। শেয়ারবাজারকে সবার কাছে একটি আস্থার জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে।'
তদন্ত কমিটির প্রধান জিয়া উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'যেসব জায়গায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তা আমরা সাংবাদিকদের বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে বের করব।'
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও তদন্ত কমিটির সদস্য মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, 'এই সুযোগ বারবার আসে না। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, আমাদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব।'
তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য মো. শফিকুর রহমান বলেন, 'ছাত্র-জনতা একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমাদের যে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা কাজ করতে চাই।'