রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিনিয়োগে স্থবিরতায় চলতি অর্থবছরের ২ মাসে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমেছে ১৩%
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং স্থবির বিনিয়োগ সহ বিভিন্ন কারণে আমদানি সংক্রান্ত লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা এবং নিষ্পত্তির পরিমাণ প্রায় ১৩ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে ১০.০৩ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার কম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অস্থিরতার কারণে ব্যাংকগুলোতে এলসির জন্য চাহিদা কমেছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, "জুলাই মাসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শত শত মানুষের মৃত্যু এবং এর জের ধরে, মাসের একটা বড় অংশ জুড়ে দেশে অস্থিরতা থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।"
তিনি বলেন, "এছাড়া ঐ মাসে ৫ দিন ইন্টারনেট ব্লকেজ এবং ব্যাংক বন্ধ থাকায় আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনেও ব্যাঘাত ঘটেছে। এর ফলে, জুলাই মাসে আমদানি এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি– দুটোই কমেছে।"
ঐ ব্যাংকার আরও বলেন, "আগস্ট মাসে নতুন সরকার গঠনের পর ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ পাচ্ছেন না।"
তিনি জানান, আগস্টে বেশ কয়েকটি কারখানা ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। পাশাপাশি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে আন্দোলনের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে, ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকায় এখনই নতুন বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না।
এভাবে চলতে থাকলে, আমদানির পাশাপাশি রপ্তানিও কমে যেতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।
খাতভিত্তিক আমদানি এলসি খোলার চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুই মাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পতন ছিল মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে, যা গত দুই মাসে ৪৪ শতাংশ কমেছে। তারপরে, পেট্রোলিয়াম আমদানিতে কমেছে ৩৬ শতাংশ।
জুলাই-আগস্ট মাসে মাত্র ২৮৬ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল বাদে অন্য সব খাতে আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমদানি নির্ভর দেশ হিসেবে প্রতি মাসে আমাদের আমদানি কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার হওয়া উচিত। অর্থনীতির আকার অনুযায়ী, আমাদের আরো বেশি আমদানির প্রয়োজন। এভাবে আমদানি কমে যাওয়া অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো খবর নয়।"
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া দেশে বিনিয়োগ কমে যাওয়াকেই নির্দেশ করে মন্তব্য করে এই ব্যাংকার বলেন, "মেশিনারিজ আমদানি কমায় বোঝা যাচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিগুলো তাদের ক্যাপাসিটি এক্সপানশন করছে না। অনেক আমদানি নির্ভর ফ্যাক্টরি বন্ধ আছে। ফলে, এলসি খোলাও কমে এসেছে বলে মনে হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "তবে, আমাদের আরো কয়েকমাসের আমদানি এলসি খোলার বিষয়টিতে ভালোভাবে নজর রাখতে হবে।"
আমদানি এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৩.০৮%
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানি এলসি পেমেন্ট করা হয়েছে ১০.৩৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় শেষে এলসি পেমেন্ট করা হয়েছিল ১১.৯০ বিলিয়ন ডলার।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এটিকে গত দুই বছরে আমদানি এলসি খোলার ধারাবাহিকভাবে হ্রাস বলে অভিহিত করেছেন। ফলে একই ধারাবাহিকতায় এলসি পেমেন্টও কমে এসেছে।
খাতভিত্তিক আমদানি এলসি পেমেন্টের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ৩৩ শতাংশ এলসি পেমেন্ট কমেছে মুলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে। ভোগ্যপণ্য আমদানি কমেছে ৩২ শতাংশ। এছাড়া চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে পেট্রোলিয়াম ও মধ্যবর্তী পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য আমদানি পেমেন্ট কমেছে।
ব্যাংক খাতে ডেফার্ড এলসির পরিমাণ কমে আসায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পেমেন্টের চাপ কম মন্তব্য করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর টিবিএসকে বলেন, "আমরা এখন পেমেন্ট শিডিউল করে এলসি খুলছি। ফলে আমাদের ডেফার্ড পেমেন্টের চাপ কমে গিয়েছে।"
সরকারি ব্যাংকগুলোতে ওভারডিউ পেমেন্টের চাপ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এই ব্যাংকগুলো সরকারের অনেক আমদানির ব্যয় পরিশোধ করে। বর্তমানে এসব ব্যাংকে ১.৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি ওভারডিউ পেমেন্ট রয়েছে।"
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, পেমেন্টের সময়সীমা চলে গেলেও ডলারের অভাবে এসব পেমেন্ট করা যায়নি। ফলে, পেমেন্টগুলো দ্রুত করতে এই ব্যাংকগুলো এখন কিছুটা বেশি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে।
ব্যাংকগুলোর তথ্যমতে, সেগুলো রেমিট্যান্স ডলার কিনতে প্রতি ডলারে প্রায় ১২০ টাকা দিচ্ছে, যেখানে আমদানি পেমেন্টের হার ১২০.৩০ টাকা থেকে ১২০.৫০ টাকার মধ্যে রয়েছে।