এক বছরে ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১ লাখ কোটি টাকা
২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.৮৭ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংকাররা বলছেন, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ব্যাপক ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়েছে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের শেষে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩.৭৮ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১.০৯ লাখ কোটি টাকা।
এই ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের তথ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের অন্যতম শর্ত হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে গত বছর প্রথমবারের মতো ২০২২ সালের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সর্বশেষ এই আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদন মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিলকৃত ও অবলোপনকৃত ঋণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই সবগুলো মিলিয়ে ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪.৮৭ লাখ কোটি টাকা।
এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১.৪৫ লাখ কোটি টাকা, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ ২.৮৮ লাখ কোটি টাকা এবং অবলোপনকৃত ঋণ ৫৩ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
একটি ব্যাংক কেবল সেই ঋণই অবলোপন করতে পারে, যা পুনরুদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নেই এবং কমপক্ষে তিন বছর ধরে 'মন্দ/ক্ষতিজনক' মানে শ্রেণিকৃত ছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে বাধ্যতামূলকভাবে অবলোপন করা ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে হয়। অবলোপনের আগে প্রভিশন রাখতে সংশ্লিষ্ট ঋণের হিসাবের মধ্যে স্থগিত সুদ বাদ দিয়ে হিসাব করতে হয়।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ব্যাংকিং খাতে নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের এনপিএল ২ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি হলেও এস আলমসহ কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণ এনপিএলে পরিণত হলে সেটি অফিশিয়ালি ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা হয়ে যেতে পারে। এই পরিমাণটা হবে আইনি কাঠামোসহ বিভিন্ন জায়গায় থাকা ঋণগুলো বাদেই।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২ শতাংশের কম। তবে এস আলম গ্রুপের ঋণসহ বড় ঋণগুলো বিবেচনায় নিলে নন-পারফর্মিং লোনের হার ২০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে।
'চীনসহ অনেক দেশে একসময় এনপিএলের অনুপাত ৩০-৪০ শতাংশে উঠে গিয়েছিল,' মন্তব্য করে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'অনেক এনপিএল হওয়ার পরেও সেটিকে সময়ের সঙ্গে ম্যানেজ করে নিয়ে আসা হয়েছে।'
এই ব্যাংকার আরও বলেন, 'এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সব খাতে শক্তিশালী নেতৃত্ব দরকার। একইসঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রক ও আইনি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের নিয়ে ভারতে একটা মাস্টার সার্কুলার হয়েছিল; আমাদের সেটি অনুসরণ করা উচিত। এছাড়া রেগুলেটরি অনেক নিয়মের সংশোধন নিয়ে আসাও দরকার।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতের সম্পদের গুণগত মান খারাপ হওয়ার একটি কারণ হতে পারে নিয়মিত, পুনঃতফসিলকৃত বা পুনর্গঠিত ঋণের ওপর নজরদারির অভাব। আরেকটি কারণ হতে পারে নন-পারফর্মিং লোন আদায়ে ধীরগতি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতসহ অন্যান্য বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতের সম্পদের গুণমানের অবনতি ঘটাতে পারে।
২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে রেকর্ড ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা।
এর আগে সর্বোচ্চ পরিমাণে ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ২০১৯ সালে, ৫১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। ওই বছর বড় ঋণগুলোকে পুনঃতফসিলের জন্য ওয়ান টাইম এক্সিট পলিসি সুবিধা দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পলিসি সুবিধা ২০২৩ সালে ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ বাড়াতে অবদান রাখতে পারে। এছাড়াও কিছু নির্দিষ্ট খাতের ঋণ (যেমন জাহাজ নির্মাণ ও হিমাগার-সংক্রান্ত ঋণ) দীর্ঘমেয়াদে পুনঃতফসিলের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
পুনঃতফসিলকৃত বাকি ঋণের বেশিরভাগই শিল্প, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ঋণ, যা যথাক্রমে মোট পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ২৬.৪ শতাংশ, ২০.৯ শতাংশ এবং ১১.৩ শতাংশ।
শিল্পভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ৬৪.৮ শতাংশ বৃহৎ শিল্প, ১০.৫ শতাংশ মাঝারি শিল্প এবং ১৫ শতাংশ অন্যান্য শিল্প পেয়েছে।
শীর্ষ ৩ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে ২৬ ব্যাংক
২০২৩ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুসারে, শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে ২৬টি ব্যাংক তাদের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা বা ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটস রেশিও (সিআরএআর) বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে।
সিআরএআর হচ্ছে একটি ব্যাংকের মূলধনের সাথে ব্যাংকটির রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ এবং বর্তমান ঋণের অনুপাত।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। 'বাসেল ৩' নীতি অনুসারে, বাংলাদেশে ঋণদাতাদের তাদের রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটের ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যে পরিমাণটি বেশি, সেটি সংরক্ষিত মূলধন হিসেবে রাখতে হবে। কোনো ব্যাংক নির্ধারিত এই পরিমাণ সংরক্ষণ করতে না পারলে, তা ওই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
গত বছরের মূল্যায়নে মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ২২। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে 'প্রি-শক' পরিস্থিতিতে ১০টি তফসিলি ব্যাংক ন্যূনতম সিআরএআর বজায় রাখতে পারেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমন চাপের পরিস্থিতিতে শীর্ষ তিন বড় ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি বিবেচনা করলে আরও ১৬টি ব্যাংক ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সিআরএআর বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে। এছাড়া খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ শতাংশ বাড়লে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে আরও পাঁচটি ব্যাংক।
শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে এবং খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশ বাড়লে বিদ্যমান সিআরএআরের আওতায় যথাক্রমে আরও ২৭টি ও ১৩টি ব্যাংক ২.৫০ শতাংশ ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি) বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ও সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এই ঋণগ্রহীতারা খেলাপি হলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের সিআরএআর ১১.৬৪ শতাংশ থেকে ৭.৫০ শতাংশে নেমে আসবে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের সিআরএআর দাঁড়িয়েছিল ১১.৬৪ শতাংশ, যা এর আগের বছরে ছিল ১১.৮৩ শতাংশ।
তবে এটি এখনও ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ন্যূনতম ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতার চেয়ে বেশি। ২০২৩ সাল শেষে সিআরএআর বজায় রাখা ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে ৫১-তে পৌঁছেছে।
এদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ১৬.৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৯.৭ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কায় ১৬.৯ শতাংশ।
ব্যাংকিং খাতের মুনাফা
২০২৩ সালে ব্যাংকিং খাতে পরিচালন মুনাফা ১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালে যেখানে এ খাতে পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৪ হাজার ২২২ কোটি টাকা, সেখানে ২০২৩ সালে তা বেড়ে ৩৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যদিও নিট সুদ আয় বেড়েছে ২০.৬৩ শতাংশ।
তবে ২০২৩ সালে মূলত সুদ-বহির্ভূত ব্যয় অনেকটা বাড়ায় ব্যাংকিং খাতের নিট পরিচালন আয় ২০২২ সালের তুলনায় ৩২.৯৫ শতাংশ কমেছে।
ফলে ২০২৩ সালে নিট মুনাফা ৪.৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ হাজার ৮৪১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ১৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকা।
এছাড়া ২০২৩ সালে ঋণ ক্ষতির ব্যয় বা প্রভিশন বরাদ্দ ২৪ শতাংশ বেড়ে ১০ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা হয়েছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৮ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা।