বকেয়া ভ্যাট ও জরিমানার ৭,০০০ কোটি টাকা: ফ্রিজ হচ্ছে এস আলমের ২ কোম্পানির অ্যাকাউন্ট
ভ্যাট ফাঁকি ও জরিমানা বাবদ ৭ হাজার কোটিরও বেশি টাকা পরিশোধ না করায় এস আলমের সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড ও এসআলম ভেজিটেবল অয়েল মিলস লিমিটেডের ব্যবসায়িক কার্যক্রম—আমদানি ও স্থানীয় বিক্রি—বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি ও সমপরিমাণ জরিমানার অর্থ পরিশোধের জন্য এস আলম গ্রুপের ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে দুটিকে তাগাদা দেওয়া হলেও এখন তারা ওই অর্থ পরিশোধ করেনি বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর কর্মকর্তারা।
এ অবস্থায় এনবিআর প্রতিষ্ঠান দুটোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার পাশাপাশি বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) লক করতে যাচ্ছে বলে জানান তারা।
সোমবার (৭ অক্টোবর) চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা তাদেরকে বকেয়া ভ্যাট পরিশোধের জন্য চিঠি দিলেও তারা ওই অর্থ পরিশোধ করেনি। এ অবস্থায় আগামীকাল (মঙ্গলবার) নাগাদ তাদের ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করার জন্য চিঠি পাঠানো হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'তাদের বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বরও ডিঅ্যাকটিভেট করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে আগামীকাল চিঠি পাঠানো হবে। সেক্ষেত্রে তাদের (আলোচ্য দুটি প্রতিষ্ঠানের) আমদানি ও রপ্তানিসহ সব ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।'
সূত্র জানায়, কেবল আমদানি নয়, বিআইএন লক হলে স্থানীয়ভাবে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ও লেনদেনও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
দেশের ব্যাংকিং খাতসহ পুরো ব্যবসা খাতে বর্তমানে বিতর্কিত নাম চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একে একে বেরিয়ে আসছে এই গ্রুপের বিভিন্ন অনিয়মের খরব।
ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির দখলে থাকা পাঁচটি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেগুলোতে বড় আকারের আর্থিক অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এছাড়া ট্যাক্স অফিসও এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির গত পাঁচ বছরে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেনের তথ্য উদ্ঘাটন করেছে।
চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট ২০২৩ সালে এস আলমের আলোচ্য দুটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনে অডিট শুরু করে। গত মে মাসে ওই অডিটের প্রতিবেদনে দুটি প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির তথ্য বেরিয়ে আসে। এর সঙ্গে সমপরিমাণ অর্থ জরিমানাও করে প্রতিষ্ঠানটি দুটিকে শো-কজ নোটিশ পাঠানো হয়।
কিন্তু ওই নোটিশ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করে প্রতিষ্ঠান দুটি। তাদের রিট আমলে নিয়ে ওই আদেশ বাতিল করে কেন পুনরায় শুনানির নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন আদালত।
চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'এর পর আলোচ্য দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের শুনানির জন্য ডাকা হলেও তারা আসেননি।'
এর পরই বকেয়া ভ্যাট আদায়ের জন্য আইনগত পথে হাঁটার উদ্যোগ নেয় ভ্যাট অফিস।
সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, 'তাদেরকে প্রথম শো-কজ নোটিশ থেকে ফাইনাল নোটিশ দেওয়া পর্যন্ত ৯ মাস সময় গেছে। কিন্তু তারা সঠিক জবাব দিতে পারেনি। টাকাও পরিশোধ করেনি।'
চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট সূত্র জানায়, গত ২৭ আগস্ট বকেয়া অর্থ আদায়ের জন্য নিয়োগকৃত ডেবট রিকভারি অফিসার (ডিআরও) আসিফ আহমেদ অনিক চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে অবস্থিত এস আলম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানকে টাকা পরিশোধের জন্য ২১ দিনের সময় দিয়ে 'বকেয়া কর আদায় সার্টিফিকেট' নামে একটি নোটিশ দেন।
ওই নোটিশের একটি কপি টিবিএসের হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে: 'এই সার্টিফিকেট ইস্যুর ২১ দিনের মধ্যে কোনো জবাব পাওয়া না গেলে বা বকেয়া পরিশোধ করা না হলে বিদ্যমান আইনের ৯৫ ধারা অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হবে।'
বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আইনের ৯৫ ধারা অনুযায়ী, খেলাপি করদাতাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ, ব্যবসা অঙ্গন থেকে পণ্য বা সেবার সরবরাহ বন্ধ করা, বিআইএন লক করা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তালাবদ্ধ করা, ইউটিলিটি সার্ভিস বন্ধ করা, এমনকি মামলামাল ক্রোক করার আদেশও দেওয়া যায়।
এই ধারা প্রয়োগ করেই এবার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে ভ্যাট অফিস।
আমদানি বন্ধ ও বিআইএন লক হলে বাজারে প্রভাব পড়বে কি?
বর্তমানে দেশে বার্ষিক ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২৩ লাখ টন। এর মধ্যে মাত্র ৩ লাখ টনের মতো সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, যা মোট চাহিদার প্রায় ১৩ শতাংশ জোগান দেয়। অর্থাৎ সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রায় ৯০ শতাংশ ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে।
এস আলম গ্রুপ দেশের ভোজ্যতেলের বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ আমদানি করে। ২০২৩ সালের নভেম্বরের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, ২০২২ সালে এস আলম গ্রুপ প্রায় ৬.৭৮ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করেছে, যেখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৯১৮ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১০ হাজার ৯৮ কোটি টাকা।
অন্যান্য ভোজ্যতেল বিপণনকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা মনে করেন, এস আলমের প্রতিষ্ঠান দুটির আমদানি বন্ধ ও বিআইএন লক হয়ে গেলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা খুব কম।
বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের অর্থ ও হিসাব বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ দবিরুল ইসলাম দিদার টিবিএসকে বলেন, 'সাপ্লাই চেইনে তাদের (এস আলমের দুই প্রতিষ্ঠানের) বড় একটি স্টেক ছিল। সেজন্য অন্যদের রেডি হতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু বাজারে তেমন কোনো অসুবিধা হবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা চাই প্রকৃত ব্যবসায়ীরা মাঠে থাকুক। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হোক।'
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের ডেপুটি চিফ মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।