বাণিজ্য সংগঠনগুলোয় টানা দুই মেয়াদের বেশি পদে থাকা যাবে না
বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে গণতন্ত্র ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এজন্য দেড় আগে চূড়ান্ত করা বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা সংশোধন করে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এটি কার্যকর করা হলে একই ব্যক্তি কোন বাণিজ্য সংগঠনের প্রেসিডেন্ট বা অন্য কোন পদে পরপর দুইবারের বেশি নির্বাচন করতে পারবেন না।
এছাড়া, দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) এর পরিচালনা পর্ষদ থেকে মনোনিত পরিচালক অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি বাতিল হতে পারে।
এ দু'টি বিধান যুক্ত করা হলে, সংগঠনগুলোতে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরে আসবে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এতে সংগঠনগুলোতে নতুন করে দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসবে বলে মনে করছেন তারা।
১৯৯৪ সালে প্রণীত বাণিজ্য সংগঠন আইন ২০২২ সালে সংশোধন করার পর পরই নতুন আইনের আলোকে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা, ২০২৩ এর খসড়া চূড়ান্ত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নতুন আইনে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি কোন বাণিজ্য সংগঠনে পরপর দুইবারের বেশি একই পদে নির্বাচন করতে পারবে না।
সে অনুযায়ী, বিধিমালায়ও একই ধরণের বিধান যুক্ত করে খসড়া চূড়ান্ত করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালের এপ্রিলে খসড়াটি ওয়েবসাইটে প্রকাশও করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ও বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনে বছরের পর বছরে ধরে প্রেসিডেন্ট বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতাদের চাপে বিধিমালাটি পাস করে কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এখন সেই খসড়া বিধিমালা সংশোধন করে তা কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বাণিজ্য সচিব মো. সেলিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা সংশোধন করার প্রস্তুতি চলছে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজী হননি তিনি।
এফবিসিসিআই এর সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দীন টিবিএসকে বলেন, একজন ব্যাক্তি কোন বাণিজ্য সংগঠনে পরপর দুই বারের বেশি একই পদে নির্বাচিত হতে পারবেন না- এমন বিধান আইনে থাকলেও বিধিমালায় যুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ব্যবসায়ীদের একটি অংশের আপত্তির কারণেই তা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ও সরকার থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত এফবিসিসিআই এর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'একজন ব্যক্তি কোন বাণিজ্য সংগঠনে পরপর দুইবারের বেশি একই পদে থাকতে পারবেন না- এমন বিধান বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালায় যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
'প্রাথমিক খসড়ায় এফবিসিসিআই এর পরিচালনা পর্ষদে মনোনিত পরিচালক রাখার বিধান বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। এটি হলে এফবিসিসিআই এর পরিচালনা পর্ষদের সবাইকে সরাসরি সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। তবে এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের মতামত সংগ্রহ করা হবে। সকল ব্যবসায়ীর মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে'- জানান তিনি।
মো. হাফিজুর রহমান বলেন, এফবিসিসিআইতে পরিচালক মনোনিত করার বিধান বাতিল করা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটি বাতিল করা হলে এফবিসিসিআইতে কোন কোন সেক্টরের প্রতিনিধিত্ব নাও থাকতে পারে। তাই ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
এফবিসিসিআই পরিচালনা পর্ষদের মোট ৮০ জন পরিচালকের মধ্যে চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ১৭ জন করে মোট ৩৪ জন পরিচালক মনোনীত হন। বাকিরা নির্বাচিত হন।
প্রভাবশালী ও সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন নামে নিত্যনতুন অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে এবং প্রভাব খাটিয়ে এফবিসিসিআই এর পরিচালনা পর্ষদে মনোনিত পরিচালক হিসেবে যোগদান করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে দিন দিন সংগঠনটিতে মনোনিত পরিচালকের সংখ্যা বাড়ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এফবিসিসিআই এর মনোনিত পরিচালক প্রথা বাতিল করার দাবি তুলেছে। তারা সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদের আকার বিদ্যমান ৮০ জন থেকে কমিয়ে অর্ধেক করার প্রস্তাব দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের শিল্পখাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে এফবিসিসিআই এর গবেষণা করার কথা থাকলেও সেদিকে সংগঠনটির মনোযোগ কম। বরং সংগঠনটির নেতারা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায় ও সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালন করছে। বিশেষ করে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সংগঠনের নেতারা সরাসরি আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগেও এফবিসিসিআই এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন সরাসরি সরকার দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের আর্শীবাদে। তার বিপক্ষে অন্য কেউ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার সাহসও দেখাতেন না। ২০১৪ সালের পর থেকে এফবিসিসিআই সহ অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো থেকেও গণতন্ত্র বিদায় নিতে থাকে। বেশিরভাগ সংগঠনেই আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ীরা ভোটে কিংবা বিনা ভোটে নেতৃত্ব দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা নেতারা জানান, ১৯৯৪ সালে সালমান এফ রহমান সরাসরি সাধারণ পরিষদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের পদ্ধতিটা কিছুটা বদলানো হলো। সাধারণ পরিষদের সদস্যরা ভোট দিয়ে পরিচালকদের নির্বাচিত করেন। সেই পরিচালকদের ভোটে নির্বাচিত হতেন সভাপতি ও সহসভাপতিরা।
২০০১-২০০৪ সময়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাণিজ্যমন্ত্রী থাকার সময় নিয়মকানুনে পরিবর্তন আনা হলো। অনেক বড় বড় বাণিজ্য সংগঠন ও চেম্বারের নেতারা সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পরিচালনা পর্ষদে যেতে পারেন না, এমন যুক্তিতে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করতে মনোনয়নব্যবস্থা চালু হলো। তখন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, ঢাকা চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বারসহ আটটি বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের এফবিসিসিআইয়ের পর্ষদে নিয়ে আসা হয়। বাকিরা নির্বাচন করে পর্ষদে এলেন।
এরপর থেকে প্রতিবছরই একজন, দুজন করে মনোনীত পরিচালকের সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৮ সালে আনিসুল হক সভাপতি থাকার সময় এফবিসিসিআইয়ের পর্ষদ ছিল ৩৮ জনের। বর্তমানে তা বেড়ে ৮০ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ জন মনোনয়নের মাধ্যমে এসেছেন।